সংক্ষিপ্ত
- ঝাড়গ্রাম জেলার ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে বিনপুর
- ২০১৪, ১৬ ও ১৯-এর ভোটে তৃণমূল এগিয়ে ছিল এখানে
- এসটি প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত আসন
- ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা তৃণমূলকে সমর্থন করছে
শমিকা মাইতি, প্রতিনিধি, বিনপুর ২ ও জামবনি ব্লক এলাকা নিয়ে বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি গঠিত। ২০১১ সালের পর থেকে ১৪, ১৬ ও ১৯-এর ভোটে এই এলাকায় এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। তবে পঞ্চায়েত ভোটের সময় জঙ্গলমহলের অন্যান্য এলাকার মতো বিনপুরেও পদ্মফুল ফোটে। এবং, তারপর থেকে এই এলাকায় বিজেপি ক্রমেই তার শক্তি বাড়িয়েছে। কিন্তু আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকায় ভোটের বল সুইং করে আদিবাসীদের মন যে দিকে যায়, সেই দিশায়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা প্রকাশ্যেই তৃণমূলকে সমর্থন করছে। তারা প্রার্থী দেয়নি। আদিবাসীদের আর একটি রাজনৈতিক সংগঠন ঝাড়খণ্ড পার্টি(নরেন)-ও প্রার্থী দেয়নি। উল্লেখ্য, এই দলের নেত্রী চুনীবালা হাঁসদার মেয়ে বীরবাহা এবার ঝাড়গ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন। ফলে শেষবেলা দু’পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
এদিকে, মার্চ মাসের প্রথম দিকে ভোটের মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতে ভোট বয়কটের ডাক দিয়ে বিনপুরের বেশ কিছু গ্রামে মাওবাদী পোস্টারের দেখা মিলেছে। সেখানে বিজেপি আর তৃণমূলকে ভোট দিতে বারণ করা হলেও ‘কমরেড’ সিপিএমদের নিয়ে কিছু বলা হয়নি।
বিনপুর বিধানসভা আসনে কে-কত বার জয়ী
১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচনে বিনপুরের যুগ্ম আসনে জেতেন কংগ্রেসের মঙ্গলচন্দ্র সরেন ও নৃপেন্দ্রগোপাল মিত্র। সিপিআইয়ের সুধীরকুমার পাণ্ডে ও জমাদার হাঁসদা ১৯৫৭ সালে এই যুগ্ম আসন থেকে জেতেন। এরপর ১৯৬২ ও ৬৭ সালের ভোটে পরপর এই আসন থেকে জেতেন কংগ্রেসের মঙ্গলচন্দ্র সরেন। ১৯৬৯ সালে সিপিআই প্রার্থী জয়রাম সরেন জয়ী হন। ১৯৭১ সালে ঝাড়খণ্ড পার্টির শ্যামচরণ মুর্মু জেতেন। ১৯৭২ সালে আবার জয়রামবাবু জিতে যান। ১৯৭৭ সালে সিপিআই(এম) প্রার্থী শম্ভুনাথ মাণ্ডি জনতা পার্টির দক্ষিণ মুর্মুকে হারিয়ে দেন। ১৯৮২ সালেও শম্ভুনাথবাবু জেতেন। সেবার তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নির্দল প্রার্থী নরেন হাঁসদা। ১৯৮৭ সালের ভোটে সিপিআই(এম) প্রার্থী দুর্গা টুডু কংগ্রেসের পঞ্চানন হাঁসদাকে হারান। ১৯৯১ ও ৯৬-এর ভোটে দুর্গাদেবীকে হারিয়ে দেন ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর প্রতিষ্ঠাতা নরেন হাঁসদা। ২০০১ সালে নরেনবাবুর স্ত্রী চুনীবালা হাঁসদাকে হারিয়ে দেন সিপিআই(এম) প্রার্থী শম্ভুনাথ মাণ্ডি। ২০০৬ সালে চুনীবালাদেবী পাল্টা হারিয়ে দেন শম্ভুনাথবাবুকে। ২০১১ সালে সিপিআই(এম)-এর হয়ে দাঁড়িয়ে দিবাকর হাঁসদা ৬০,৭২৮টি ভোট পান। চুনীবালাদেবী ৫৩,১২৮টি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকেন। সেবারেও তৃণমূলের কোনও চিহ্ন ছিল না এলাকায়।
ধীরে ধীরে এলাকায় তৃণমূল সংগঠন বিস্তার করে। মূলত লালগড় আন্দোলনের মুখ যারা ছিল তাদের হাত ধরেই জোড়াফুলে ছেয়ে যায় এলাকা। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল ৫৩.৪০ শতাংশ ভোট পায়। ৫৫.০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০১৬ সালে এই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জেতেন তৃণমূলের খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম। প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক দিবাকর হাঁসদা ৪৯ হাজারেরও বেশি ভোটের মার্জিনে দু’নম্বরে ছিলেন।
কিন্তু একসময় যাঁরা তৃণমূলের পতাকা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই এখন নাম লিখিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। পঞ্চায়েত ভোটে আশাতীত ভাবে এই সব এলাকায় ভাল ফল করেছে বিজেপি।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নিরিখে এই বিধানসভা কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ২১৬৬০৭। ভোট পড়েছিল ১৭৫৭৪৯। ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী জিতলেও বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলই লিডে ছিল (৪৩.৩৫ শতাংশ ভোটশেয়ারিং)। ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী বীরবাহা সোরেন এই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৭৬১৯৭টি ভোট পেয়েছিলেন। বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম পেয়েছিলেন ৭৩১৩৮টি ভোট। সিপিএমের দেবলীনা হেমব্রম পেয়েছিলেন ১০৩০১টি ভোট।
গত লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলের আদিবাসী ভোটের বড় একটা অংশ তৃণমূলের বিপক্ষে পদ্মশিবিরে গিয়েছিল। এবার কিন্তু ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা প্রকাশ্যেই তৃণমূলকে সমর্থন করছে। প্রার্থীও দেয়নি তারা। অন্য দিকে, ঝাড়খণ্ড পার্টি(নরেন)-ও প্রার্থী দেয়নি।
ঘাটালে সবুজ-গেরুয়ার লড়াইয়ে ফিকে লাল রঙ, ভোটের আগে ছবিটা ঠিক কেমন ...
করোনা-মহামারির সঙ্গে যুদ্ধের একটা বছর পার, ফিরে দেখা লকডাউনের দিনগুলি ...
প্রসঙ্গত, ঝাড়খণ্ড পার্টি(নরেন)-র সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক কখনও অম্ল, কখনও মধুর। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা নরেন হাঁসদাকে আদিবাসী সমাজ বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তিনি দু’দফায় বিনপুরের বিধায়ক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী চুনীবালাদেবী বিধায়ক হয়েছেন। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট চুনীবালাদেবীকে সমর্থন করেছিল। তবুও বামেদের প্রার্থী দিবাকর হাঁসদার কাছে হেরে যান চুনীবালাদেবী। এদিকে, রাজ্যে ক্ষমতার পালা-বদলের সময় ঝাড়খণ্ড পার্টি(নরেন)-র অনেক নেতা-কর্মী তৃণমূলে চলে যান। এই সময় থেকে চুনীবালার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় তৃণমূলের। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) তৃণমূলের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে নিজেদের প্রার্থী দেয়। বিনপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হন নরেনের মেয়ে বীরবাহা। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও ঝাড়গ্রাম কেন্দ্র থেকে দলীয় প্রতীকে বীরবাহা দাঁড়িয়েছিলেন। দু’বারেই হেরে যান তিনি। সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দেন সাঁওতালি সিনেমার মহানায়িকা বীরবাহা। তারপর থেকেই দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে জল্পনা চলছিল। বীরবাহাকে ঝাড়গ্রামে তৃণমূলের প্রার্থী করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শেষ চাল’ চেলেছেন। বিনপুরে নিজের এলাকাতেও এবার প্রার্থী দেয়নি ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)।