সংক্ষিপ্ত
- টিকাকরণের প্রথম দিনই বিতর্ক পিছু নিয়েছে
- চিকিৎসকরদের একাংশই কোভ্যাক্সিন নিতে নারাজ
- টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই
- গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ সরকারের
তপন মল্লিক- দেশজুড়ে টিকাকরণের প্রথম দিনই বিতর্ক পিছু নিয়েছে। খোদ চিকিৎসকরদের একাংশই কোভ্যাক্সিন নিতে নারাজ। তাঁরা কোভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শনিবার অর্থাৎ টীকাকরণের প্রথমদিন দিল্লির রামমোহন লোহিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা হাসপাতালের সুপারকে চিঠি লিখে জানান, কোভ্যাক্সিনের ট্রায়াল নিয়ে তো আশঙ্কা রয়ে গিয়েছে। কাজেই তাঁরা এখন এই ভ্যাকসিন নেবেন না, পরে ঠিকমতো ট্রায়াল হলে তবেই তারা করোনার এই ভ্যাকসিন নেবেন বলে চিঠিতে সাফ জানিয়েছেন। কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের ওপরেই যে তাদের ভরসা সে কথা চিকিৎসকরা স্পষ্টই জানিয়েছেন। কারণ এই টিকা তিনটি ধাপই পার করেছে। কিন্তু কোভ্যাক্সিনের এখনও ট্রায়াল চলছে। তবে চিকিৎসকদের এসব যুক্তি কেন্দ্রীয় সরকার খুব একটা গায়ে মাখছেন না বলেইমনে হচ্ছে। কেন্দ্রের ব্যাখ্যা, দু'টি ভ্যাকসিন তৈরি করতে বিশেষজ্ঞরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন বলেছেন, দুটি ভ্যাকসিনের মধ্যে বাছাইয়ের কোনও প্রশ্নই নেই। তিনি গুজবে কান না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন- করোনা টিকা নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার পরে মৃত্যু, ভ্যাকসিন থেকে মৃত্যু নয় বলে দাবি সরকারের
বাস্তব পরিস্থিতি হল; টিকাকরণের আগে যে তিনটি ধাপ রয়েছে, সেগুলি পার করেছে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড। এটি ভারতে তৈরি করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট। অন্যদিকে হায়দরবাদের সংস্থা ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন এখনও তিনটি ধাপ পার করেনি। অথচ সেই টিকাকে তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কেবল তাই নয়, ৬টি কেন্দ্রীয় হাসপাতালে দেওয়া হবে কোভ্যাক্সিন আর বেসরকারি, সরকারি মিলিয়ে ৭৫টি হাসপাতালে দেওয়া হবে কোভিশিল্ড। এই নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক ছিল এখনও তা অব্যাহত। লক্ষণীয় আমি বা আপনি কোন টিকাটি নেব সেটাও আমরা নিজে থেকে বাছতে পারব না। সরকার আমাদের জন্য যেটি বরাদ্দ করবেন সেই টিকাটি আমাদের নিতে হবে। কংগ্রেস কেন্দ্রের এই ধরণের নীতি নিয়ে সমালোচনা করছে। সাধারণ মানুষ কী গিনিপিগ, সেই প্রশ্ন করেছেন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মণীশ তিওয়ারি। এর আগে কোভ্যাক্সিন নেওয়ার ন'দিনের মাথায় ভোপালে ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। একটি বেসরকারি হাসপাতালে কোভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। যদিও কোভ্যাক্সিন নেওয়ার কারণেই ওই ব্যক্তির মৃত্যুর হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট হয়। তবে শনিবার দেশজুড়ে টিকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকেই যেমন কোভ্যাক্সিন নিয়ে বিতর্ক ছিল তাকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দেয় দিল্লির রামমোহন লোহিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন- কোভিডে দৈনিক মৃত্যু কমল কলকাতায়, রাজ্য সুস্থতার হার বেড়ে ৯৭ ছুঁইছুঁই
"
দেশ জুড় জরুরি ভিত্তিতে করোনার প্রতিষেধক দেওয়ার অভিযান শুরু করে সরকার প্রথম দিন প্রতিষেধক দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সরকারি ভাবে তার কারণও ব্যাখ্যা করেনি। তবে তাদের আলোচনায় দু’টি প্রতিষেধকের মধ্যে ভারতে তৈরি কোভ্যাক্সিন-কে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ককেই এর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ১২টি রাজ্যে দু’ধরনেরই প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বাকি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কেবল কোভিশিল্ড ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী প্রথমদিন পশ্চিমবঙ্গের ১৮৩টি টিকাকেন্দ্রতে মোট ৯৫৮২ জন প্রতিষেধক নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব মনোহর আগনানি এর পরও বলেন, প্রথম দিনের অভিযান সফল। কিন্তু প্রথম দিনই যে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ১.১ লক্ষ কম সংখ্যক মানুষ প্রতিষেধক নিলেন তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি আগনানি বা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে। তবে আগনানি জানিয়েছেন, করোনা প্রতিষেধক দেওয়া নিয়ে সরকারি অ্যাপ ‘কোইউন’-এ তথ্য আপলোড করার ক্ষেত্রে প্রথম দিন কিছু সমস্যা হয়েছিল। পরে এও জানা যায়, ওই অ্যাপের সফটওয়্যারে সমস্যার জন্য মহারাষ্ট্র সোমবার পর্যন্ত প্রতিষেধক অভিযান বন্ধ রেখেছে। এক্ষেত্রেও কোভ্যাক্সিন-বিতর্ককে দায়ী করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ। কেবল তাই নয়, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রতিষেধক নেওয়া নিয়েও দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রথমে সম্মতি জানিয়েও পরে পিছিয়ে গিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক কেন্দ্রে হাজির হননি। আরও একটি বড় কারণ যে ১২টি রাজ্যে দু’ধরনের প্রতিষেধক ব্যবহার হচ্ছে। কোভ্যাক্সিন প্রতিষেধকটি নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক তবু সেটি দেওয়া হচ্ছে শুনে অনেকেই পিছিয়ে আসেন।
করোনার মতো একটি প্রতিষেধক নেওয়া বাধ্যতামূলক না-হওয়ায় সরকার কারু ওপর জোরও খাটাতেও পারছে না। অন্যদিকে শনিবার টিকাকরণ শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকেরা কোভ্যাক্সিন দেওয়া নিয়ে আপত্তি জানালে সে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পরে। এমনিতেই ওই প্রতিষেধকটির নিরাপত্তা ও তার কার্যকারিতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল। তার অপর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই প্রতিষেধক নিতে বেঁকে বসলে সাধারণ মানুশঢ আর ওই প্রতিষেধকের ওপর কিভাবে আস্থা রাখতে পারেন। তার ওপর শনিবার প্রতিষেধক নেওয়ার পরে দিল্লিতে ৫১ জন স্বাস্থ্যকর্মীর জ্বর ও অ্যালার্জির মতো সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তা নিয়েও সামান্য হলেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী নিজে বা মন্ত্রিসভার কোনও নেতা কেন প্রতিষেধক নিলেন না। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সবার আগে ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধানরা প্রথমে প্রতিষেধক নিলে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বার্তা যায় যে, সেটি নিরাপদ। এক্ষেত্রে তেমনটা হল না। কোভিশিল্ড নিয়ে কোনও সংশয় না থাকলেও, ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন টিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন থাকা স্বত্বেও ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া বা ডিসিজিআই তাকে অনুমোদন দিয়েছে। কোভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা এবং তা কতটা নিরাপদ তা নিয়েও বম্বে হাইকোর্টে দায়ের হয়েছে জনস্বার্থ মামলা।