সংক্ষিপ্ত

ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যে ডার্বিতে এই ম্যাচ আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে (Surajit Sengupta Passes Away)। এই ম্যাচ খেলা হয়েছিল মোহনবাগানের (ATK Mohun Bagan) ঘরের মাঠে। ফলে লাল-হলুদের এই জয় বিশাল মাত্রা পেয়েছিল। ঘরের মাঠে দলকে এভাবে সুরজিৎ সেনগুপ্তর অবিস্মরণীয় ফুটবল স্কিলের সামনে পরাস্ত হতে দেখে কার্যত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন সবুজ-মেরুণ সমর্থকরা (Footballer Surajit Sengupta)।
 

ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বিতে ১৯৭৫-এর শিল্ড ফাইনাল এক ইতিহাস তৈরি করে রয়েছে। সে সময় ময়দান শাসন করছিল লাল-হলুদ। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল একটাও ডার্বি না হারার রেকর্ড করেছিল। এই ডার্বি জয়ে ১৯৭৫-এর শিল্ড ফাইনাল একটা ঐতিহাসিক মাত্রা যোগ করে দিয়েছিল। সেদিন ফাইনালে প্রথম গোল করে খাতাটা খুলেছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। খেলা শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ মিনিটে এই গোলটি করেছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। তখন তিনি ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক। সুরজিৎ সেনগুপ্ত-এর অধিনায়কোচিত গোলে যেন আরও তেড়ে ফুঁড়ে ওঠে লাল-হলুদের ফুটবলার। সুভাষ ভৌমিক থেকে শ্যাম থাপা, রণজিৎ মুখোপাধ্যায়, শুভঙ্কর স্যানালরা। 

এই হারের বেদনা মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যে এতটাই গভীর প্রভাব ফেলেছিল যে মাঠের গ্যালারিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এক সমর্থক। উমাশঙ্কর পালধি নামে এক সবুজ-মেরুণ সমর্থক আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড নোটে উমাশঙ্কর লিখে যান, তিনি পরের জন্মে ফুটবলার হবেন এবং একজন মোহনবাগান ফুটবলার হিসাবে এই হারের প্রতিশোধ নেবেন। ঐতিহাসিক ডার্বিতে তাই  আজও উমাশঙ্করের অভিশাপ এবং তাঁর আত্মহত্যার কালো দাগ রয়ে  গিয়েছে। 

১৯৬৮ সালে কলকাতা ময়দানে খেলতে এসেছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। ১৯৭৩ সালে শৈলেন মান্নার হাত ধরে মোহনবাগান ক্লাবে সই করেছিলেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন ঘর করা হয়নি সুরজিৎ সেনগুপ্তর। খুব দ্রুত সুরজিৎ-এর এফেক্টিভ উইং প্লে সকলের নজর টানে। আর ইস্টবেঙ্গল সুরজিৎ সেনগুপ্তকে সই করিয়ে নেয়। ইস্টবেঙ্গল তখন ময়দানে অপ্রতিরোধ্য। এমনকী দেশজুডড়েও একের পর এক প্রতিযোগিতায় লাল-হলুদই সেরা। ১৯৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। আইএএফ শিল্ডের ফাইনালে প্রথম পাঁচ মিনিটেই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে ড্রিবল করে গোল করেন তিনি। আর ছয় মিনিটের মোহনবাগানের পেনাল্টি বক্সে শ্যাম থাপাকে বিচ্ছিরিভাবে ট্র্যাকল করেন তপন বাসু। এর পরিণামে ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি পায়। কিন্তু শ্যাম থাপা গোল করে দলকে এগিয়ে দিতে ব্যর্থ হন। এর কিছুক্ষণ পরেই সুভাষ ভৌমিকের করা একটি ক্রস মোহনবাগান গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে ফিস্ট করতে গিয়ে বল তালু বন্দি করতে ব্যর্থ হন। বল সামনে থাকা শ্যাম থাপার পায়ে চলে যায়। এবার আর ভুল করেননি ইস্টবেঙ্গলের এই ফুটবলার। ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। এই ম্যাচের তৃতীয় গোলটা ছিল পাস খেলার এক অসাধারণ ফসল। সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুভাষ ভৌমিক এবং শ্যাম থাপা নিজেদের মধ্যে পাস খেলতে খেলতে প্রতিপক্ষের বক্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই তিন জনকে আটকাতে সামনে চলে আসে মোহনবাগানের পুরো রক্ষণ। এই সুযোগে রণজিৎ মুখোপাধ্যায় মোহনবাগানের রক্ষণে নিমাই গোস্বামীকে ধোকা দিয়ে পজিশন নিয়ে নেন। পাস বাড়ানো হয়েছিল রণজিৎ-এর উদ্দেশে। কোনও ভুল করেননি তিনি। ৩-০ গোলে ব্যবধান বাড়িয়ে নিয়েছিল সুরজিৎ সেনগুপ্ত-র নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণভাগ। এই গোল যখন এসেছিল তখন খেলার বয়স ৩৮ মিনিট। 

এরপর ৫১ মিনিটে সুরজিৎ সেনগুপ্তর করা শটকে মোহনবাগানের গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় ফিস্ট করতে গিয়ে ফের ফসকান। বল চলে যায় শ্যাম থাপার পায়ে। তিনি পুরো ফাঁকা গোল বল ঠেলতে ভুল করেননি। এরপর ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে তুলে নিয়ে প্রশান্ত মিত্রকে গোলে নামালেও ইস্টবেঙ্গলের লাগাতার স্কোরিং আটকানো যায়নি। শুভঙ্কর স্যানাল ইস্টবেঙ্গলের হয়ে পঞ্চম গোলটি করেন।

ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যে ডার্বিতে এই ম্যাচ আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এই ম্যাচ খেলা হয়েছিল মোহনবাগানের ঘরের মাঠে। ফলে লাল-হলুদের এই জয় বিশাল মাত্রা পেয়েছিল। ঘরের মাঠে দলকে এভাবে সুরজিৎ সেনগুপ্তর অবিস্মরণীয় ফুটবল স্কিলের সামনে পরাস্ত হতে দেখে কার্যত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন সবুজ-মেরুণ সমর্থকরা। মাঠের মধ্যেই গ্যালারিতে এক মোহনবাগান সমর্থক হৃদরোগে আক্রান্ত হন।  তবে সবকিছুকে নাড়িয়ে দেয় উমাশঙ্কর পালধির আত্মহত্যা। রাতের বেলায় আত্মঘাতী হন সবুজ-মেরুণ সমর্থক উমাশঙ্কর পালধি। সুইসাইড নোটে লিখে যান- একজন ভালো ফুটবলার হয়ে পরের জন্মে জন্ম নিয়ে এই হারের প্রতিশোধ নেবেন তিনি। 
বলতে গেলে এই ঘটনা এি ঐতিহাসিক ডার্বির গৌরবে এক কলঙ্কের কালি লেপন করে দিয়েছিল। তবে, ফুটবলের মক্কা কলকাতার ময়দানে এমন ফুটবল আবেগ সেই সময় অবিংসবাদি-র তকমা পেয়েছিল। উমাশঙ্করের আত্মহুতি যেন বাঙালির ফুটবল পাগলামোর এক চূড়ান্ত নির্দশন যা বাঙালির সেরা খেলা কেন ফুটবল তা যেন আরও একবার প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে, এর জন্য উমাশঙ্করকে কেউ শহিদের তকমা দেয়নি। এমনকি এই সময়ে কয় জন মানুষ উমাশঙ্করের মতো এক অসামান্য ফুটবলার আবেগের নাম জানে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। 

আরও পড়ুনঃ'তিনি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবেন', সুরজিৎ সেনগুপ্তর প্রয়াণে শোকাহত মুখ্যমন্ত্রী

আরও পড়ুনঃ'এমন উইঙ্গার বাংলার ফুটবলে আর আসবে না', সুরজিত সেনগুপ্তের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ 'ময়দান'

আরও পড়ুনঃ'ঘরের ছেলের' প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ইস্টবেঙ্গল, ময়দান থেকে গোয়া শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সুরজিৎ সেনগুপ্তকে

তবে, কলকাতা ময়দানের সেই সময়ের ফুটবল উন্মাদনায় সুরজিৎ সেনগুপ্ত ছিলেন এক প্রকৃতপক্ষে তারা। তাঁর অর্থডক্স উইংপ্লে এশিয়া মহাদেশের ফুটবল খেলিয়ে দেশগুলোর নজর টেনেছিল। খেলোয়াড় জীবনের অধিকাংশ সময়টাই ইল্টবেঙ্গলে খেলেছেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। লাল-হলুদের হয়ে করেছেন ৯৮টি গোল। চারবার টানা বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। এশিয়ান গেমসেও দেশের হয়ে প্রতিনিধত্ব করেছিলেন।