আধ ভাঙা কাপে রোমের আস্ত কলেসিয়াম, ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে নাম তুলল বালুরঘাটের সৃষ্টি
স্বপ্নপূরণ বোধহয় একেই বলে। যে ইচ্ছাপূরণের আবেশ তাকে ঘিরে রাখে সবসময়ে, সেই ইচ্ছেপূরণটা যে এভাবে হয়ে যাবে তা ভাবতেই পারেনি সৃষ্টি। ভাবনার আকাশের সঙ্গে সৃষ্টির ভাব শৈশবের। মনের কোলে খেলে যাওয়া নানা অনুভূতি কখনও তার উদাত্ত কন্ঠে গানের মাধ্যমে বা কখনও আবার অঙ্কনশৈলির মধ্যে দিয়ে ডানা মেলেছে। কথায় রয়েছে যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো কিছু অমূল্য রতন। আর এভাবেই এখন ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে বালুরঘাটের সৃষ্টি মুখোপাধ্যায়।
- FB
- TW
- Linkdin
একটা ভাঙা কাপ দেখে চোখ আটকে গিয়েছিল সৃষ্টির। কাপটা এমন করে ভাঙা ছিল যে তারমনে খেলে বেড়াচ্ছিল নানা দৃশ্য। এর কিছুদিন আগেই একটা পুরনো বেরঙ হয়ে যাওয়া কেটলিকে রাজস্থানী অঙ্কণে জীবনদান করেছিল সে। এই ভাঙা কাপটি-তে সেটা সম্ভব? ভাবনার দুনিয়ার এক আইডিয়া খেলে গিয়েছিল সৃষ্টির।
ভাবনার আকাশে পাখাটা মেলতেই কাজ শুরু করে দেয় সৃষ্টি। আস্তে আস্তে সেই ভাঙা কাপের মধ্যে রঙের জাদুকরীতে সে ফুঁটিয়ে তোলে একটা আস্ত কলেসিয়াম। যার সঙ্গে রোমের কলেসিয়ামের পুরো সাদৃশ্য সে তৈরি করে। বলতে গেলে একটা স্মলেস্ট ভার্সান অফ কলেসিয়াম। তাও আবার একটা ভাঙা কাপের গায়ে। সৃষ্টির কথায়, আসলে কাপটা এমনভাবে ভেঙেছিল যে মনে হয়েছিল ওতে কলেসিয়ামটা ফুঁটিয়ে তোলা যায়।
ভাঙা কাপে কলেসিয়াম ফুঁটে উঠতেই তার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সৃষ্টি। সেখানে প্রবল জনপ্রিয়তা পায় তার শিল্পকর্ম। বিভিন্ন জনের পরামর্শে তার শিল্পকর্ম নিয়ে সৃষ্টি পৌঁছয় ইন্ডিয়া বুক রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের কাছে।
সৃষ্টির শিল্পকর্ম অবাক করে ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস কর্তৃপক্ষকেও। তারা প্রাথমিকভাবে মেনে নেয় যে সৃষ্টি-র এই শিল্পকর্ম যথেষ্ট শক্তিশালী এবং রেকর্ড তৈরির ক্ষেত্রে সে এমন শিল্পকর্ম নিয়ে অবতীর্ণ হতে পারে। ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস সৃষ্টির এই শিল্পকর্ম-কে মাগ আর্টস বিভাগে নির্বাচিত করে এবং তাকে প্রথম চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে বলা হয়। যা ছিল চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামার আগে নির্বাচিত হওয়ার ম্যাচ।
ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে আরও একটি মাগ আর্টস করতে হয়েছিল সৃষ্টি-কে। এসবই মাস খানেক আগের গল্প। শুধু মার্গ আর্টস করাই নয় তার আনকাট ভিডিও পাঠাতে হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এমনকী বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে শিল্পকর্মের ছবিও তুলে পাঠাতে হয়।
রেকর্ডস গড়ার লড়াই-এ সৃষ্টি যে এবার অংশ নিতে পারেন তা তাকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দেয় ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস। ফাইনালের লড়াইয়ে সৃষ্টিকে ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে আরও ৭ থেকে ১০টি মাগ আর্টস করে দেখাতে বলা হয়। এর জন্য যাবতীয় নিয়ম কানুনও তাকে বলে দেয় ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ।
আরও ৭টি মাগ আর্টস-এ হাত দেয় সৃষ্টি। এর জন্য তাকে কাপের মেজারমেন্ট থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ শিল্পকর্মের বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে স্থীর ছবি তুলতে হয়। এছাড়াও করতে হয় ভিডিও। যে ভিডিও-তে আবার কোনও ধরনের এডিট থাকলে হবে না। ৭টি মাগ আর্টস-এর ছবি এবং ভিডিও ৭ দিনের মধ্যে ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস-এর কাছে জমা করে দেয় সৃষ্টি।
শেষ পর্যন্ত সৃষ্টির মাগ আর্টস-কে দেখে স্বীকৃতি দেওযার কথা ঘোষণা করে ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস। ৯ অগাস্ট সৃষ্টি-কে মেল করে সুখবর দেয় তারা। মেলেই জানানো হয় যে এত কম সময়ে এত সুন্দর নৈপুণ্যতাকে বজায় রেখে সৃষ্টি ৭টি মাগ-কে যেভাবে আঁকার মাধ্যমে রাঙিয়ে তুলেছে তা একটি রেকর্ড। আর সেই কারণ সৃষ্টির শিল্পকর্মকে রেকর্ডস বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা।
রেকর্ড গড়ার স্বীকৃতি হিসাবে একটি কিট বক্স এবং তার সঙ্গে সার্টিফিকেট, মেডেল পাঠায় ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস। সঙ্গে তারা পাঠায় একটি পেন এবং আই কার্ডও। প্রতিটি জিনিসের উপরেই ইন্ডিয়া বুক রেকর্ডস সৃষ্টির নজিরকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তাও লিখে দিয়েছে। পুজোর আগে এমন নজির স্থাপন এবং তার স্বীকৃতি মেলায় এখন বেজায় খুশি সৃষ্টি।
তার নজির আপাতত তাকে খবরের শিরোনামেও এনে দিয়েছে। বালুরঘাটের উত্তর চকভবানীর বাসিন্দা সৃষ্টি। বাবা স্বায়ন্তন মুখোপাধ্যায় রাজ্য সরকারের কর্মী। মা জয়া মুখোপাধ্যায় গৃহবধূ। ছোট থেকেই মা-বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন সৃজনমূলক কাজের সূত্রটা পেয়ে এসেছে সে। এর সঙ্গে অবশ্যই ছিল তার ঠাকুমার করা নানা হাতের কাজ। যা স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টির মননে এক সৃষ্টিশীলতার স্ফুরণ ঘটাতে সাহায্য করেছে।
উচ্চমাধ্যমিকে বড়ই ইচ্ছে ছিল জেলায় ব়্যাঙ্ক করার। কিন্তু ১ নম্বরের জন্য সেরা হওয়া হয়নি। কোথাও না কোথাও মনের কোণে আজ সেটা নাড়া দেয় সৃষ্টিকে। তবে, মাগ আর্টস করে এবং তাতে রেকর্ড বুকে নাম তুলে এখন বেজায় খুশি সৃষ্টি। তার শিল্পকর্মকে সকলে চাক্ষুষ করছে, সকলে বাহবা দিচ্ছে- এটা ভেবে খুবই আনন্দিত সে।
ছোট থেকেই প্রবল জেদি সৃষ্টি। একবার যে কাজটা-তে ঢোকে সেটাকে যে কোনওভাবে সুন্দর করে গুছিয়ে তুলতে তার নাকি জুড়ি মেলা ভার। এমনই মন্তব্য করেছেন সৃষ্টির মা জয়া মুখোপাধ্যায়। মেয়ে-র সাফল্যে তিনিও অবশ্য ভাগীদার শুধুমাত্র জন্মদাত্রী বলেই নয়, তিনি মেয়েরে শিল্পকর্মের ভিডিও করে দেওয়ার যাবতীয় ভারটা নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন।
সন্তানের সাফল্য যে কোনও বাবা-মা-কেই নাড়া দেয়। স্বায়ন্তন মুখোপাধ্যায় একজন নিয়ম-নিষ্ট মানুষ বলেই পরিচিত। প্রবল শৃঙ্খলা পরায়ণ ও সংৎ মানুষ বলেও এলাকায় পরিচিত। নিজেও বিভিন্ন ধরনের খুঁটি-নাটি সুক্ষ কাজে তাঁর সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বারবার রেখেছেন। সুতরাং, এমন বাবার মেয়ে হিসাবে সৃষ্টিও যে এক পরিপূর্ণ সৃষ্টিশীল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে তাতে কারওই কোও সন্দেহ ছিল না। সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে মেয়ের সাফল্যে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেননি স্বায়ন্তন।
ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার রাস্তাটা যে সহজ ছিল না তা মনে করছে সৃষ্টি। চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা যাতে সে ঠিক করে করতে পারে তার জন্য কাকা-কাকিমা, বোন এবং ঠাকুমা-ঠাকুর্দা সকলেই নানাভাবে তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে জানিয়েছে সৃষ্টি।
ছোট থেকে গানের প্রশিক্ষণ বাড়িতে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল গীতিতেও নিজেকে একজন সুদক্ষ সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে গড়ে তুলেছে সৃষ্টি। রয়েছে তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলও। এছাড়াও নৃত্য পরিবেশনে জেলায় নানা সময়ে নানা সম্মানে সম্মানিত হয়েছে সে।
অতিমারির প্রথম ধাক্কাতেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে সৃষ্টি। একটা সময় পড়াশোনার জীবন কোন দিকে যাবে তা তাকে চিন্তায় ফেলেছিল। বিশেষ করে অতিমারি এবং লকডাউন তার মতো ছাত্র-ছাত্রীদের একটা সময় হতাশ করে ফেলেছিল। অবশেষে আইন-এর স্নাতক স্তরে ভর্তি হয় সৃষ্টি। লক্ষ্য নিজেকে আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে নাম তুলে ফেলা হয়ে গিয়েছে মানেই যে মাগ আর্টস অথবা এমন কোনও শিল্পকর্মকে এখনই কেরিয়ার হিসাবে বেছে নিতে রাজি নয় সৃষ্টি। তার আপাতত লক্ষ্য পড়াশোনা শেষ করা। আর যেমনভাবে সে তার সৃষ্টিশীলতায় জীবন দান করছে তা বজায় রেখে যাওয়া। এভাবেই এখন তার সাফল্যকে উপভোগ করতে চায় সৃষ্টি।