- Home
- World News
- International News
- ১০ বছর পুরুষ সেজে ধোকা দিয়েছিলেন তালিবানদের - নাদিয়ার কাহিনি হার মানায় রূপকথাকেও, দেখুন
১০ বছর পুরুষ সেজে ধোকা দিয়েছিলেন তালিবানদের - নাদিয়ার কাহিনি হার মানায় রূপকথাকেও, দেখুন
- FB
- TW
- Linkdin
সত্যি বলতে নাদিয়ার কাহিনি হার মানায় রূপকথাকেও। সেইসময় আফগানিস্তান বিধ্বস্ত ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে। তালিবানরা একেবারে দাঁত-নখ বের করে আছে। বোমা-গুলির ধোঁয়ায় এক দমচাপা অবস্থা। এই পরিস্থিতিতেই ১৯৮৫ সালে কাবুল শহরে জন্ম হয়েছিল নাদিয়া গুলাম দস্তগীরের।
একেবারে ছোট থেকেই তালিবানি শাসনের স্বাদ পেয়েছিলেন নাদিয়া। বুঝে গিয়েছিলেন এই বর্বরদের শাসনে বাঁচার অধিকারই নেই মেয়েদের। যখন তখন বাড়ি থেকে মহিলাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার, হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ - সবই ঘটতে দেখেছিলেন চোখের সামনে। আর ১৯৯৩ সালে যখন নাদিয়ার বয়স মাত্র ৮, তালিবানদের ছোড়া একটা বোমা এসে পড়েছিল তাদের বাড়িতে। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বাড়ির একাংশ। পরিবারের সবাই প্রাণে বেঁচে গেলেও, সেই সৌভাগ্য হয়নি নাদিয়ার ভাইয়ের। নাদিয়াকেও বোমার আঘাত নিয়ে দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছিল হাসপাতালে।
১৯৯৬ সালে কাবুল পুরোপুরি তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। গৃহযুদ্ধ জয় করে আফগানিস্তানের তখত দখল করেছিল তারা। আর এই ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে নাদিয়ার জীবনও পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল। নাদিয়ার বয়স তখন ১১। পরিবারে কোনও পুরুষ নেই। তালিবানি ফতোয়ায় তাদের কারোর বাইরে বের হওয়ারও উপায় নেই। অনাহারের মুখে চলে গিয়েছিল তার পরিবার। আর সেই সময় তাঁর মায়ের কথাতেই প্রথম পুরুষের বেশ পরেছিলেন নাদিয়া। নিজের মহিলা সত্ত্বাকে মেরে ফেলে, সামনে এসেছিলেন মৃত ভাইয়ের পরিচয়ে।
নাদিয়া জানতেন, তাঁকেই পরিবারের হাল ধরতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তালিবানি অত্যাচার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদও ছিল। তাই, মৃত ভাইয়ের পরিচয়ে পুরুষ হয়ে নাদিয়া বাইরে বের হতে শুরু করেছিলেন। চলে গিয়েছিলেন মসজিদে। শুরু করেছিলেন কোরান পাঠ। কয়েকদিন পরে কাবুলের ওই মসজিদেই কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এভাবে পুরুষ সেজে দিনের পর দিন তালিবানদের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন তিনি। সেই উপার্জনের টাকাতেই খাবার উঠত তাঁর পরিবারের মুখে। আর এই পুরুষ হওয়ার সুবিধা হিসাবে তাঁর স্কুলে পড়াশোনা করা নিয়েও কোনও আপত্তি করেনি তালিবানরা।
এই ভাবেই পুরুষের পরিচয়ে ১০ বছর অজ্ঞাতবাসে কাটিয়েছিলেন নাদিয়া। প্রতি মুহূর্তে নিজের নারী সত্ত্বা মুছে ফেলে আরও বেশি 'পুরুষ' হয়ে ওঠার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন তিনি। শরীর-মনে চলত সর্বক্ষণের দ্বন্দ্ব। মানসিক-শারীরিক এই দ্বন্দ্বে পাগল পাগল লাগত তাঁর। তবু নিজের ও পরিবারের স্বাধীনতার কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে মননে, চেতনায়, চলাফেরায় কোনদিন যে পুরোদস্তুর পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন তা তিনি বুঝতেও পারেননি।
তবে নিজেকে যতই পুরুষ করে তুলুন না কেন, তিনি তো আদপে নারীই। তাই একটা সময়ের পর এই ভেক ধরাটা আর সম্ভব হচ্ছিল না নাদিয়ার পক্ষে। বয়স যত বাড়ছিল, ততই পোশাক ছাপিয়ে জানান দিচ্ছিল তাঁর নারীসত্ত্বা। আর জোর করে পুরুষের পরিচয় বয়ে যেতে যেতে একসময় মনে মনে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন তিনি নিজেও। সেটা ২০০৬ সাল। আফগানিস্তানে তালিবানের মুঠি অনেকটাই আলগা। এক মানবাধিকার সংস্থার সাহায্যে কাবুল থেকে পালিয়ে স্পেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সেখানে পৌঁছেও নিজের পুরুষ সত্ত্বাকে ভুলতে পারেননি নাদিয়া। নারী-পুরুষ এই দ্বৈত সত্ত্বার টানাপোড়েন কাটাতে স্পেনের এক হাসপাতালে বেশ কিছু চিকিৎসা চলেছিল তাঁর। তবে নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি। তারপর স্পেনের এক আফগান শরণার্থী শিবিরে ঠাই নিয়েছিলেন। আর ২০১০ সালে নিজের এই দুর্দান্ত কাহিনি বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন পর, সারা বিশ্বের সামনে নিজেকে নারী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন নাদিয়া।
পরবর্তীকালে স্পেনেই উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন নাদিয়া। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০১৬ সালে 'ব্রিজেস অব পিস' নামে একটি বেসরকারি সংস্থা স্থাপন করেছেন তিনি। সেই সংস্থার কাজ, স্পেনের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের শিক্ষাদান।
তাঁর পরিবার এখনও আফগানিস্তানেই রয়ে গিয়েছে। দেশ ছাড়ার পর থেকে পরিবারের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। তাঁরা আদৌ কেউ বেঁচে আছেন না নেই তাও জানেন না তিনি। জানার কোনও উপায়ও নেই। আর তালিবানদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর দেশে ফেরার আশাও আর করেন না তিনি। পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি।
তবে তাঁর আফশোষ তাঁর মতো আরও অনেক 'নাদিয়া' এখনও রয়ে গিয়েছে আফগানিস্তানে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়ে দিন কাটাচ্ছে তারা। আর সারা বিশ্ব সব দেখেশুনে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। আফগানিস্তানকে সকলে একা করে দিয়েছে। নাদিয়াদের হাত ধরার আর কেউ নেই।