- Home
- West Bengal
- West Bengal News
- নামকরণ, অনুকরণ এবং নাকচ - কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি নিয়ে কোন খেলায় মেতেছেন মমতা, দেখুন
নামকরণ, অনুকরণ এবং নাকচ - কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি নিয়ে কোন খেলায় মেতেছেন মমতা, দেখুন
গত সপ্তাহেই রাজ্যে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ করেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। দাবি করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী কিষান নিধি-সহ কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির সুবিধা বাংলার অভাবী মানুষরা পান না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনগণের কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করছেন, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় সেগুলির নাম বদলে তাঁর চালু করা প্রকল্প বলে মিথ্যা কৃতিত্ব দাবি করছেন। সত্যিই কি তাই? নাকি ভোটের আগে স্রেফ বাজার গরম করে গেলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী?
- FB
- TW
- Linkdin
'দুহাতে লাড্ডু' থেকে 'ডাবল ইঞ্জিন'
নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে স্লোগান উঠেছে, 'খেলা হবে'। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বলেছেন গোলরক্ষকের ভূমিকা নেবেন। বস্তুত, বহুদিন আগে থেকেই তিনি গোলরক্ষকের ভূমিকাতেই আছেন। একটিও কেন্দ্রীয় প্রকল্প নামক বল যাতে বাংলার মাঠে ঢুকে পড়, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যাতে একটিও গোল করতে না পারেন, তার ব্যবস্থা তিনি একেবারে মোদী জমানার শুরু থেকেই করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী অবশ্য ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে বলে গিয়েছিলেন, রাজ্যে দিদি আর কেন্দ্রে মোদী থাকলে দুহাতে দুই লাড্ডু পাবে বাংলা। তবে, কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়। এইবারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে তাঁকে বলতে হচ্ছে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের কথা। বহিরাগত কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বাংলায় প্রবেশ রুখে দেওয়ার খেলাটা দিদি খেলেন তিনটি স্ট্র্যাটেজিতে - বঙ্গীয় নামকরণ, নকলিকরণ এবং সরাসরি নাকচ করে দেওয়া।
বঙ্গীয় নামকরণ
প্রথমেই দেখা যাক বঙ্গীয় নামকরণ, যার অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। বহু কেন্দ্রীয় প্রকল্পই বাংলায় চালু হয়েছে বঙ্গীয় নামে। উদাহরণ দেওয়া যাক - 'প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা' হয়েছে 'বাংলার গ্রামীণ সড়ক যোজনা', 'প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা' হয়েছে 'বেঙ্গল গৃহ প্রকল্প', 'স্বচ্ছ ভারত মিশন' হয়েছে 'মিশন নির্মল বাংলা', ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন বা 'আজীবিকা' প্রকল্পের নাম হয়েছে 'আনন্দধারা', 'বেটি বাচাও বেটি পড়াও'-এর নাম হয়েছে 'কন্যাশ্রী', দীন দয়াল উপাধ্যায় গ্রাম জ্যোতি প্রকল্প বাংলায় এসে নাম পেয়েছে 'সবার ঘরে আলো'।
এভাবে কি নাম বদলানো যায়
আসলে এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির ৬০ শতাংশ অর্থ দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, বাকি ৪০ শতাংশ রাজ্য। ৪০ শতাংশ তাঁর সরকার দেয় বলে নাম বদলানোর সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাঁর। এমনটাই দাবি করেছেন মমতা। কেন্দ্র একা কৃতিত্ব নিয়ে যাবে, ৬০ শতাংশ অর্থ দিয়ে, এটা হতে পারে না।
নকলিকরণ
কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির বঙ্গীয় নামকরণ করা ছাড়াও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকারি প্রকল্পও চালু করেছেন, যেগুলি বলা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পগুলির হুবহু নকল। হয়তো সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঊনিশ-বিশ পার্থক্য রয়েছে। বেশি দূর যেতে হবে না, কেন্দ্রের চালু করা প্রধানমন্ত্রী কিষাণ নিধির অনুকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে চালু করেছেন কিষাণ বন্ধু, এবং আয়ুষ্মান ভারতের আদলে রয়েছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প। মমতা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে কিষাণ বন্ধু এবং স্বাস্থ্যসাথীই চলবে, কেন্দ্রের প্রকল্প তাঁরা গ্রহণ করবেন না।
এতে সমস্যা কোথায়
তৃণমূল সরকার প্রাথমিকভাবে রাজ্যের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা দেবে বলেছিল। ভোটের আগে সেই লক্ষ্য বাড়িয়ে বাংলার সমগ্র (প্রায় ১০ কোটি) জনসংখ্যাকেই এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে রাজ্যের কোষাগারে প্রতি বছরে অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকার চাপ পড়বে। একইভাবে কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুবিধোভোগীর সংখ্যা ৫২ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৩ লক্ষ। এই প্রকল্পের জন্য বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ ৩০০০ কোটি টাকা। পিএম কিষাণ নিধি এবং আয়ুষ্মান বারত প্রকল্পের ব্যয়ভার কিন্তু কেন্দ্র একাই বহন করে। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একই রকমের প্রকল্প রয়েছে, সেখানে সেই প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে রাজ্য়ের কোষাগারে চাপ কমানো যেত। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ বছর বাদেও বাম আমলের ঋণের বোঝার কথা বলে বেড়ান।
কেন আয়ুষ্মান বা পিএম কিষাণ নেন না মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ক্ষেত্রে দুটি যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, তাঁর দাবি কৃষক বন্ধু এবং স্বাস্থ্যসাথী - দুটি প্রকল্পই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের আগে চালু করেছেন। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রের থেকে তাঁর প্রকল্পগুলি অনেক ভালো। পিএম কিষাণ সম্মান নিধির আওতায় প্রত্যেক কৃষক বছরে ৬০০০ টাকা করে ভাতা পান। এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন বাংলার ৭০ লক্ষ কৃষক। অন্যদিকে, এক একর বা তার কম জমির মালিক, বাংলার এমন সকল কৃষকই পাবেন কৃষকবন্ধুর সুবিধা - বছরে ৫০০০ টাকা করে ভাতা এবং ২ লক্ষ টাকার জীবনবীমা। কোন প্রকল্প ভালো সেটা তর্কের বিষয়। কিন্তু, যদি রাজ্যের কৃষকরা দুটি প্রকল্পেরই সুবিধা একসঙ্গে পেতেন, তাহলে কী ক্ষতি হত? সেই ক্ষেত্রে বছরে ৬০০০ বা ৫০০০-এর বদলে ১১০০০ টাকা করে পেতেন তাঁরা। একই কথা বলা যায় আয়ুষ্মান ভারত ও স্বাস্থ্যসাথীর ক্ষেত্রে।
পুণশ্চ, পিএম কিষাণ
পিএম কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা অবশ্য এখানেই শেষ হয়ে যায় না। নির্বাচনের আগ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি গ্রহণ করতে রাজ হয়েছিল। তবে তারপরই ফের কেন্দ্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে এই প্রকল্পের অর্থ সরবরাহ নিয়ে। দুর্নীতি রুখতে এই ধরণের প্রকল্পের অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সেই ব্যবস্থা নিয়ে আপত্তি জানান মমতা। তাঁর দাবি, রাজ্য সরকারের মাধ্যমেই ওই অর্থ সরবরাহ করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরণের জেদ প্রদর্শনে আখেরে ক্ষতি তৃণমূল কংগ্রেসেরই। কারণ, এই ধরণের পদক্ষেপ থেকে মানুষের মনে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়। হয়, প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরিতে থাকবে রাজনৈতিক পক্ষপাত, নাহলে এই ক্ষেত্রেও কাটমানি-দুর্নীতির গল্প আছে।
সরাসরি নাকচ
নাম বদল, অনুকরণ করা ছাড়াও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বল বাংলার জালে যাতে না জড়ায় তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে সরাসরি কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাংলায় নাকচও করে দিয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় 'স্মার্ট সিটিস মিশন', অসম-বাংলা-বিহার নিয়ে নদী সংযোগের মতো প্রকল্পগুলির সামনে সরাসরি লাল পতাকা তুলে ধরেছেন মমতা। স্মার্ট সিটির ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, রাজ্য সরকার এই প্রকল্পের অর্ধেক ব্যয় বহন করতে অক্ষম, আর এতে করে রাজ্যের কয়েকটি শহরের 'অসম উন্নয়ন' হবে, বাকিগুলির হবে না। বাংলার ৭টি শহর কেন্দ্র এই প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত করেছিল। অন্যদিকে নদীর সংযোগ স্থাপন প্রকল্পে কেন্দ্র সুপারিশ করেছিল, মানস, শঙ্কোশ, তিস্তা এবং গঙ্গা নদীকে জুড়ে একটি বোর্ড গঠনের, যাতে তিন রাজ্যে, পানীয় জল, বন্যা, সেচ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার সুবিধা হয়। তবে মমতা দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন এতে বাংলার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে, কিন্তু, তা কীভাবে হবে, সেই সম্পর্কে কিছু জানাননি।