- Home
- West Bengal
- West Bengal News
- শেষ বাজারে আচমকা মমতার হিন্দুত্বের তাস, নির্বাচনে কতটা সুবিধা দেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে
শেষ বাজারে আচমকা মমতার হিন্দুত্বের তাস, নির্বাচনে কতটা সুবিধা দেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে
নির্বাচনের মুখে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় এখন হিন্দুত্বের তাস খেলছেন, এটা স্পষ্ট। বিজেপির থেকেও তিনি বড় হিন্দু, এটা দেখাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ নেওয়ার পর থেকে তাঁর মুখে আর শোনা যায় না 'দুধেল গরু' (সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কথাই বলেছিলেন বলে মনে করা হয়)-র কথা। বরং মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী চন্ডীপাঠ করেন (যদিও অনেকসময়ই ভুল বলেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের)। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে বাদ পড়েছে সংখ্যালঘু উন্নয়নের কথা। প্রার্থী তালিকাতেও মুসলিম প্রার্থীদের শতাংশ হার কমেছে। বরং বেড়েছে তফসিলি প্রার্থীদের সংখ্যা। কিন্তু, এই আচমকা হিন্দুত্ব তাস আসন্ন ভোটে তাঁকে কতটা লাভ এনে দেবে?
- FB
- TW
- Linkdin
বাংলার রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। গত তিন দশক বাংলার রাজনীতির আবর্তিত হতো মুসলিম ভোট (মোট ভোটারের প্রায় ২৯ শতাংশ)-কে কেন্দ্র করে। তাদের যারা ১৯৯০-এর দশকে বামফ্রন্ট প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতার মোকাবিলায় এই ভোট ব্যাঙ্ক ব্যবহার করেছিল। ২০১১ সাল থেকে এই ভোট ব্যাঙ্ক সরে গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। পরিবর্তনটা ঘটে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। যার ফলে বাংলার ভোট এখন সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক নয়, সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।
কী ঘটেছিল ২০১৯-এ
লোকসভায় বিজেপি যে ১৮ টি লোকসভা আসন জিতেছিল, শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে মমতার অলক্ষ্যে বাংলায় এক নতুন ভোটব্যাঙ্কের জন্ম দিয়েছিল বিজেপি। তা হল, তফসিলি জাতি-উপজাতি ভোট ব্যাঙ্ক। বাম সরকারের পতনের সময় শুধু যে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক মমতার দিকে ঘুরে গিয়েছিল তা নয়, তফসিলি জাতির ভোট (মোট ভোটের ২৩ শতাংশ) এবং তফসিলি উপজাতির ভোটের (মোট ভোটের ৫.৫ শতাংশ)-ও অধিকাংশটাই পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু, ২০১৮ সালের নির্বাচনে কিন্তু, দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলের তফসিলি জাতি-উপজাতি অধ্যুষিত জেলাগুলিতে বিজেপি দারুণভাবে ভোট পায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় সমর্থনের ভিত্তি মুসলিম ভোটের মোকাবিলা বিজেপি করেছিল এসসি-এসটি ভোট একত্রিত করে।
ওবিসি ভোট
বাংলায়, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি ভোটারের সংখ্যা ঠিক কত, তার কোনও নির্দিষ্ট হিসাব নেই। ২০১১ সাল থেকে গত ১০ বছরের প্রায় ৩০ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র জারি করেছে মমতা সরকার। তার আগের অনগ্রসর শ্রেনির নথিভুক্ত জনসংখ্যার সঙ্গে এই সংখ্যাটা যোগ করলে মোটামুটিভাবে বাংলার মোট ভোটারের ১৩ শতাংশ এই সম্প্রদায়ভুক্ত, এরকমই একটা হিসাব পাওয়া যায়। সমস্যা হল তৃণমূল সরকারের আমলে নথিভুক্ত হওয়া অনগ্রসর শ্রেনির অধিকাংশই মুসলমান, বাদ পড়েছে হিন্দুরা। বিশেষ করে, সরকারি চাকরিতে যে ১৭ শতাংশ ওবিসি কোটা সংরক্ষণ আছে, সেই সুবিধা মুসলমানদেরই দেওয়ার জন্য বেশি উদ্য়োগ দেখিয়েছেন মমতা, এমনটাই বিরোধীদের অভিযোগ। গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি, এই ওবিসির তালিকা থেকে বাদ পড়া হিন্দু বর্ণগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে অবশ্য তৃণমূলও ওবিসি তালিকায় চারটি হিন্দু বর্ণকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া
পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে একেবারে উপর স্তর পর্যন্ত তৃণমূলের দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, তোলাবাজি, কাটমানি আদায়, আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ, সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির মতো মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। মানুষের অসন্তোষ আরো বেড়েছে রাজ্যে শিল্পায়নের অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব, কৃষি থেকে আয়ের বেহাল অবস্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। পাশাপাশি, এই অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে দিতে বিজেপি নেতারা তুলে ধরছেন কী কী কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা মমতা সরকারের বাধায় বাংলার মানুষ পাচ্ছেন না, তার তালিকা। এই প্রবল নেতিবাচক পরিবেশে মমতার আচমকা হিন্দুত্বের তাস কতটা কার্যকর হবে, তাই নিয়ে জোরালো সন্দেহ রয়েছে।
অসন্তুষ্ট মুসলমান সমাজ
তৃণমূল সরকারের এই দুর্নীতি, কাটমানি, তোলাবাজি, মার-দাঙ্গার প্রভাব যে শুধু সংখ্যাগুরু অংশের উপরই পড়েছে তা নয়, আসলে অসুস্থ প্রশাসনের প্রভাব সমাজে সবার উপর সমানভাবেই পড়ে। মুসলিম অধ্যুষিত জেলা মুর্শিদাবাদ থেকে বহু নির্মাণশ্রমিক রাজ্য়ে কাজ না পেয়ে, ভিনরাজ্যে য়েতে বাধ্য হন। লকডাউনের সময় রেশন দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল এই জেলায়। আরেক মুসলিম অধ্যুষিত জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আবার বিক্ষোভ হয়েছিল আম্ফানের ত্রাণ সরবরাহের সময়। কাজেই মুসলমানরা যে মমতার শাসনামলে খুশি, তা একেবারেই বলা যায় না। আর এর মূর্ত প্রমাণ, আব্বাস সিদ্দিকীর মতো মুসলিম নেতার পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন এবং দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ। তিনি কিন্তু বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা। মুসলমানদের তিনি ক্ষমতা দখলের সিঁডড়ি ছাড়া কিছু ভাবেননি। বিজেপি-র বিকল্প হিসাবে বাংলার অধিকাংশ মুসলিম হয়তো অসন্তোষ চেপে তৃণমূলকেই সমর্থন করতেন, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ধর্মীয় পরিবর্তনের পর, তা আর নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
বিজেপির উদ্যোগ
পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে হাওয়া যে অনেকটাই বিজেপির দিকে, তা সকলেই বুধতে পারছেন। কিন্তু, সেই হাওয়াকে ভোটে পরিণত করা কিন্তু, অন্য লড়াই। তার জন্য লাগে বুথে লড়ে যাওয়ার মতো কর্মী, বাড়ি বাডড়ি প্রচারে যাওয়ার মতো কর্মী, এলাকাকে হাতের তালুর মতো জানা কর্মীদের। সত্যি কথাটা বলে দেওয়া ভালো বিজেপির তা নেই। তবে, এই ক্ষেত্রে তারা কাজে লাগিয়েছে ভাড়াটে সৈন্যদের, অর্থাৎ, তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের। তাঁদের অনেককে প্রার্থীও করা হয়েছে। তাতে দলের অনেক পুরোনো কর্মীই ক্ষুব্ধ। কিনতু, বুথে বুথে লড়তে শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বিশ্বাসদের মতো নেতাদের লাগবে বিজেপির। এই নেতাদের অনুগামীরাই বিজেপির পক্ষের হাওয়াকে ভোটে পরিণত করবেন। কাজেই শেষ লগ্নে এসে হিন্দুত্বের তাস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনও নির্বাচনী সুবিধা দেবে, এমনটা কোনও অবস্থাতেই মনে হচ্ছে না। বরং ঘর ছেড়ে রেখে আক্রমণাত্বক কেলতে গিয়ে আরোই সমস্যায় পড়ছেন তিনি। মঞ্চ থেকে ভুল চন্ডীপাঠ করা নিয়ে মমতাকে কটাক্ষ করে ইতিমধ্য়েই 'ভেজাল হিন্দু' বলে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী।