সংক্ষিপ্ত
অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেকের অবদান রয়েছে। তবে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বই। তৈরি হয়েছে সিনেমা। কিন্তু অনেকেই কালেরগর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের অবদান ছাড়া দেশ স্বাধীন কখনই সম্ভব ছিল না। সেই সময় অনেক মহিলা এগিয়ে এসেছিলেন দেশ স্বাধীনের ব্রত নিয়ে। তবে মাতঙ্গিনী হাজরার মত অনেকেই সামনের সারিতে গিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনেকেই আবার আটপৌরে জীবনে থেকেই স্বাধীনতার ইতিহাস লিখে গেছেন। তেমনই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন ননীবালা দেবী।
ননীবালা দেবী, ষোল বছরে বিধবা হয়ে তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন। নিজে উৎসাহী হয়ে ভাইপোর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ননীবালা দেবী কখনও চন্দননগরে কখনও রিষড়াতে গৃহকর্তৃ সেজে ঘরভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন । পুলিশের চোখে ধুলো দিতেন। কলকাতার শ্রমজীবী সমবায়ে হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়েছিল। বিপ্লবী অমরেন্দ্র পালিয়ে গেলেও, ধরা পড়েছিল রামচন্দ্র মজুমদার। রামচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘মসার’ পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন জানার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা ননীবালা দেবী সধবা সেজেছিলেন। রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে শাখা সিঁদুর পরে জেলে গিয়ে জেনে এসেছিলেন পিস্তলের খবর। সেই সময় তাঁর মত বিধবাদের একাদশীর কঠোর উপবাস ছিল সঙ্গী। এক চা খেলেও জাত যেত, সিন্দুর তো দূরের কথা লালরঙ থেকে দূরে থাকত তারা। সাদা শাড়ি ,থান কাড়ই একমাত্র বস্ত্র ছিল।
সেই সময়ও দেশেব স্বাধীনতার জন্য নিজে বিধবা হয়ে অন্যের স্ত্রী সাজার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ননীবালা দেবী। সেই সময় শাখা সিঁদুর পরা অত্যন্ত দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল, সমাজের চোখে ছিল যৌনকর্মী হওয়ার সামিল ছিল এই কাজ।
তবে বিপ্লবীদের সঙ্গে ননীবালা দেবীর যোগ ছিল এই কথা ব্রিটিশ পুলিশ জানতে পারার পরেই তিনি তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর প্রবোধ চন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পেশোয়া পালিয়ে যান। এটাও কিন্তু আরও একটি দুঃসাহসিক ঘটনা। কারণ সেই যুগের বিধবা মহিলারা পুরোপুরি অন্তঃপুরবাসী ছিলেন। অনেকেই আবার বিধবাদের পাঠিয়ে দিত কাশীতে। সেই সময়ই তিনি পরপুরুষের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ করেন।
ননীবালা দেশছাড়ার পর পুলিশ তাঁর বাবা সূর্য কান্ত বন্দ্যোপাধ্য়াকে ইলিসিয়াম রো তে নিয়ে গিয়ে সকাল দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেরা করত। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ পেশোয়া যায়। ননীবালা ধরা পড়লেন যখন তখন তিনদিনের কলেরার রোগী। স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল তাঁকে হাজতে, তারপর কাশীর জেলে। জেরা করে কিছু জানতে না পেরে তৎকালীন পুলিশ কর্তা জিতেন বন্দ্যোপাদ্যায় লংকা বেটে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢেলে দেবার মত অত্যাচার চালিয়েছিল। যন্ত্রনায় ছটফট করেছেন, চিৎকার করেছেন তবু কারও সন্ধান দেননি। পরে আলো বাতাসহীন শেলেও সংজ্ঞা হারিয়েছেন বারবার তবু বিপ্লবীদের কোনো সন্ধান দেননি। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা রাজবন্দী।
জেলের সুপার ইন্টেন্ডেন্ট গোল্ডির কথামত দরখাস্ত লিখেছিলেন জেলারকে সারদামায়ের কাছে যেতে চেয়ে কিন্তু গোল্ডি নিজে হাতে ননীবালার সামনে সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন গোল্ডির গালে। এমনই আত্মসম্মান বোধ ছিল তাঁর।
এমন একজন মহিলা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সকলের কাছে অবাঞ্ছিত হলেন। বালি ছেড়ে কলকাতায় আসতে বাধ্য হলেন। শেষ জীবনে রান্নার কাজ করে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটালেন। শেষ জীবনে টিবি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯৬৭ এর মে মাসে শেষ ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন। এর পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।