সংক্ষিপ্ত

  • প্রায় দুমাস শান্তিপূর্ণ ছিল দিল্লি কৃষক আন্দোলন  
  • প্রজাতন্ত্র দিসবেই তা হিংসাত্মক হয়ে ওঠে 
  • আন্দোলনকারী কৃষকরা লালকেল্লায় তাণ্ডব চালায় 
  • যা কলঙ্কিত করেছে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ

তপন মল্লিক, প্রতিবেদক- একটানা ৬১ দিন; অর্থাৎ ২০২০-র করোনাকাল থেকে নতুন বছরের গোড়াতেও তাঁরা নিজেদের দাবিতে ছিলেন অচল। অন্য কোনও শর্ত নয়, প্রত্যাহার করতে হবে তিনিটি নতুন কৃষি আইন। কেন্দ্রের সঙ্গে একাধিক বৈঠকেও যখন কোনও সমাধানসূত্র মিলছে না তখন সরকারের ওপর আরও চাপ বাড়াতেই কৃষকরা সাধারণতন্ত্র দিবসে রাজধানীর বুকে ট্র্যাক্টর র‍্যালির ডাক দিয়েছিলেন। দিল্লি পুলিশ অনেক টালবাহানার পর শেষ পর্যন্ত কৃষকদের র‍্যালির অনুমতি দিয়েছিল। 
দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসে তিনটি নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিল ঘিরে চাপা উত্তেজনা তৈরি হচ্ছিল কয়েকদিন ধরেই। ইতিমধ্যে কৃষকদের আপোষহীন সংগ্রাম ‘বিশ্বের বৃহত্তম কৃষক আন্দোলন’ বলে পরিচিত হয়েছে। যারা দিল্লিতে শীতের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে, একাধিক মৃত্যু, আত্মহনন জয় করে, ঘরবাড়ি, পরিবার ছেড়ে দিল্লির সিংঘু সীমানায় মাটি আকড়ে পড়েছিল তাঁরা ওইদিন তাদের আন্দোলনকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন তা নিয়ে প্রতিদিনই পারদ চড়ছিল। 


যথারীতি প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিলকে কেন্দ্র করে তোলপাড় হয় রাজধানী দিল্লি। পুলিসের কার্যালয় আইটিও, নিজামুদ্দিন, লালকেল্লা-সহ অধিকাংশ রাস্তাই দখল হয়ে যায় কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিলে। দিল্লির আইটিও মোড়ে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যু, সিংঘু সীমানায় পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙা, পালটা পুলিশের লাঠিচার্জ, বিক্ষোভরত কৃষকদের সামলাতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো, সেন্ট্রাল দিল্লিতে পুলিশের বাস ভাঙচুর...একটানা ষাটদিনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ৬১ দিনের মাথায় কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন সেটাই দেখেছে রাজধানী-সহ গোটা দেশ। এর মধ্যে কিছু সময়ের জন্য লালকেল্লার দখল নিয়েছিলেন বিক্ষোভকারী কৃষকরা। সেটাও আবার প্রজাতন্ত্র দিবসে। সেখানে ওড়ানো হয় কৃষক সংগঠন নিশান সাহিবের পতাকা।
দিল্লির একা্ংশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আংশিক বন্ধ করা হয় দিল্লির মেট্রো পরিষেবা শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলন করতে দু’রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কৃষক আন্দোলনের নেতারা পর্যন্ত অনুরোধ করেছেন। লালকেল্লা থেকে কৃষকদের সরিয়ে দেওয়ার পর প্রতিবাদী কৃষকরা ফের ট্র্যাক্টরে করে এসে ভিড় জমান। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বিশেষ বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়, নিরাপত্তা ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই সিঙ্ঘু, গাজিপুর, টিকরি, মুকারবা চক, নাঙ্গলোই-এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় নামেন কৃষক আন্দোলনের সমর্থক মুখ্যমন্ত্রীরা। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত ও পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ কৃষকদের শান্তিপূর্ণ ভাবে বিক্ষোভ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। একই আবেদন করেছেন আন্দোলনের মুখ যোগেন্দ্র যাদব, রাকেশ টিকায়েতরাও। তবে তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
কৃষকদের ট্রাক্টর র‍্যালিকে হিংসা বলে আখ্যায়িত করেছেন রাহুল গান্ধী। তার বক্তব্য, হিংসা দিয়ে কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। কিন্তু কৃষকদের দাবিকে তিনি সমর্থন করেন, সেকথা আরও একবার স্পষ্ট করেই বলেছেন।  


কেউ কেউ বলছেন, লালকেল্লায় অন্য পতাকা উড়িয়ে জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হল। অনেকে আবার এও বলছেন, কৃষকদের র‍্যালি ঘিরে যে অশান্তির সৃষ্টি হল, তার কারণে দেশের রাজনৈতিক দলগুলি কৃষকদের থেকে দূরত্ব বাড়ানো শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত কৃষকদের জেদি আন্দোলনের সমর্থনে মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু, কর্নাটক,  অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরলে শুরু হয়েছে কৃষক বিক্ষোভ। মনে রাখা দরকার নয়া তিন কৃষি আইন বাতিলের যে আন্দোলন দু’মাস আগে শুরু হয়েছিল প্রজাতন্ত্র দিবসে তা এমন এক ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছায় যেখানে হাজার হাজার আপোষহীন কৃষকের জেদের সামনে পুলিশ প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন ঘরছাড়া কৃষকেরা কনকনে ঠান্ডা, সঙ্গীর মৃত্যু উপেক্ষা করে, সরকারের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে সমাধান না পেয়েও যখন আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন তখন যদি একের পর এক বাধা তাঁদের সামনে নেমে আসে তখন কি তাঁরা আন্দোলনের গায়ে মাখন লাগাবেন? নাকি বিক্ষোভ আন্দোলনকে ধরাবাঁধা কোনও সরলরেখায় চলতে হবে। দাবি আদায়ের আন্দোলনের জন্য কি নিয়মনীতি নির্ধারণ করা আছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিক্ষোভ আন্দোলনের পরিণতি হয় আপোষ বা রফা, তারা কি সেই মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার যে পথ তার কথা বলছেন? ক’ফোটা রক্ত ঝড়েছে কৃষকদের হিংসাত্মক আন্দোলনে, কতজন জখম বা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন? অথচ এমন আন্দোলন এর আগে নাকি কখনো রাজধানী দেখেনি, একদিনে এতজন মানুষ নাকি এর আগে কোনও আন্দোললে নাকি অংশ নেয়নি।    

    
সর্বস্তরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, লালকেল্লার মতো ঐতিহাসিক সৌধ, যেখান থেকে দেশের স্বাধীনতা দিবসে বক্তব্য রাখেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিবাদের নামে তার 'দখল' নিল কৃষকেরা। চাষা তাই ভদ্র লোকেদের গায়ে লেগেছে। জাতীয় পতাকার জায়গায় অন্য পতাকা। তবে ওটা খালিস্তানি পতাকা নয়, ওটা নিশান ই শাহিব। গালওয়ান ভ্যালি শিখ রেজিমেন্টে যখন ওই পতাকা ওড়ে, তখন সেটা জাতীয়তাবাদের মর্যাদা অর্জন করে আর কৃষকদের হাতের ছোঁয়ায় সেটা অবমাননায় পর্যবসিত হয়। কই আশ্চর্য ব্যাপার! দু'দিন আগে যারা সরকারি অনুষ্ঠানে ধর্মীয় স্লোগান তুলে ;বেশ করেছি;-র পক্ষে সওয়াল করেন, তারাই হঠাৎ ধর্মীয় পতাকার বিপক্ষে চলে গেলেন। তাছাড়া লালকেল্লা তো এখন আর ভারত সরকারের সম্পত্তি নয়। ২০১৮ তে বর্তমান সরকারই ২৫ কোটি টাকার বিনিময়ে ডালমিয়াদের লিজে দিয়েছে। আর পতাকা উত্তলনকারী দীপ সিধুর যে পরিচয় এখন পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে; তাতে সে বিজেপি নেতা-অভিনেতা ববি দেওলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। 
এটাই ইতিহাসের নতুন একটি অধ্যায়। বিদ্রোহী কৃষকরা লালকেল্লার দখল নিয়েছিলেন। একদিন বিদ্রোহী সিপাহীরা তাঁদের মূল ঘাঁটি এই দুর্গকে যেদিন দখল করেছিলেন সেদিনও ইতিহাস হয়েছিল। তেমনি মঙ্গলবারও নতুন ইতিহাস গড়েছেন কৃষকরা। সেই ইতিহাস প্রচন্ড শীতের দিল্লিও কৃষকের বিদ্রোহে উত্তপ্ত হয়েছিল।সেই উত্তাপ নিয়ে আবার বিতর্কও সৃষ্টি হল।