সংক্ষিপ্ত
মণিপুর সমস্যা সধামানের একমাত্র পথ হল কুকি-মেইতিদের মধ্যে সুসম্পর্ক। কি করে এই সম্পর্কের ভিত শক্ত হবে তারই হদিশ দিলেন প্রাক্তন আইপিএস।
কুকি-মেইতিদের মধ্যে দূরত্বের কারণে মণিপুরের হিংসা। ২০ জুলাই উত্তর পূর্বের বিখ্যাত লেখক জয়দীপ মজুমদার স্বরাজ্য পোর্টালে তার লেখা 'কুকি-মেইতিদের বিভাজন এখন স্থায়ী'প্রবন্ধে বলেছেন সরকার আর সমাজের ব্যর্থতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হওয়ার ঠিক আগেই ৪ জুন একটি ঘৃণ্য ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যা একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্টে পরিণত হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন।
পামরা নামে একটি প্রাক্তন জঙ্গি সংগঠন মিজোরামে থাকা মণিপুরের মেইতি সম্প্রদায়ের মহিলাদের রাজ্য ছাড়তে বলেছে।২৪ জুলাই অর্থাৎ সোমবার মিজো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন একটি প্রেস রিলিজ জারি করে। সেখানে বলা হয়েছে আঞ্চলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কতজন মেইতি রয়েছে তা জানান জন্য একটি গণনা করা হবে। মিজোরামের মিজোরাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল হয়ে পড়েছে এরই মধ্যে।
সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলিকে স্বীকার করে সূক্ষ্মতা এবং সহানুভূতির সাথে এই জাতীয় জটিল পরিস্থিতিগুলির সাথে যোগাযোগ করা গুরুত্বপূর্ণ। মণিপুরের মেইতি আর কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা আর ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন কুকিদের একটি আলাদা রাজ্য তৈরি করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান কখনই হবে না। অসম তার সমস্ত প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িয়ে রয়েছে। কারণ এই গুলি একটা সময় কুকিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।এগুলি কুকিদের জন্য পৃথক ইউনিটের ধারনাকে সুস্পষ্ট রূপ দিচ্ছিল।
কোথা থেকে এসেছে কুকা সম্প্রদায়ের মানুষ- এই প্রশ্নের উত্তর ঐতিহাসিক নথিতে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। তবে যা জানা যায় তা হল কুকিদের পূর্বপুরুষরা তিব্বত বা দক্ষিণ-পশ্চিম চিন থেকে এসেছে। চাষাবাদ ও চারণভূমির সন্ধানেই তারা সেই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। বর্তমানে কুকি সম্প্রাদায়ের মানুষদের মণিপুর, মিজোরাম, আসাম এবং নাগাল্যান্ডের পাহাড় ও উপত্যকায় দেখা যায়। কয়েক শতাব্দী ধরেই কুকি সম্প্রদায়ের অভিবাসন হয়েছিল। এই পার্বত্য এলাকায় ঘনবন কুকিদের কৃষিকাজ ও চারণভূমির জন্য উপযুক্ত ছিল।
মণিপুরে কুকিদের সঙ্গে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ১৯১০ সালের কুকি বিদ্রোহ। প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম দিকেই কর আরোপ ও চাষাবাদে বাধা মেনে নেয়নি কুকিরা। তারই জেরে আন্দোলনের সূচনা হয়। তবে ব্রিটিশরা কোনও দিনই কুকিদের তেমনভাবে বশে আনতে পারেনি।
যাইহোক ১৯৪৭ সাল থেকেই মমিপুর ভারতের অংশ। কুকি জনগণ, এই অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো, আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পরিচয় এবং অধিকার সংরক্ষণের জন্য সংগ্রাম করেছে। আজ, মণিপুরের কুকিরা রাজ্যের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তারা তাদের স্বতন্ত্র রীতিনীতি, ভাষা এবং ঐতিহ্যগত অভ্যাস বজায় রাখে এবং বিভিন্ন আধুনিক পেশা এবং ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকে। মণিপুরে কুকিদের যাত্রা এবং তাদের পরবর্তী ইতিহাস উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক টেপেস্ট্রির জটিলতা এবং সমৃদ্ধির উদাহরণ দেয়।
কেন লুক-আউট নোটিশ? অভিষেকের বিদেশ ভ্রমণ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নের সামনে ED
উভয় সম্প্রদায়েরেইএকটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এই অঞ্চলে কয়েক শতাব্দী ধরেই মেইতি ও কুকিরা বসবাস করছে। দ্বন্দ্ব থাকলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্কেরও একাধিক উদাহরণ রয়েছে। কুকি-মেইতিদের একত্রিত করার উপায় হল দুই সম্প্রদায়ের একে অপরের উৎসব উদযাপন করা। যেমন মেইতিরা কুকিদের কুট উৎসবে অংশ নেবে। আবার কুকিরা মেইতিদের ইয়াওশাং বা হোলি ও লাইহারওবারের মত উৎসবে অংশ নেবে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে, খেলাধূলার মত ইভেন্টগুলি চালু করা হয় সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি হতে পারে।
মণিপুরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও বোঝাপড়ার উন্নীত করার লক্ষ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এই সংস্থাগুলি প্রায়ই এমন প্রকল্প এবং ইভেন্টগুলিতে সহযোগিতা করে যা মানুষকে একত্রিত করে এবং তাদের ভাগ করা ঐতিহ্য উদযাপন করে। স্কুল এবং কলেজগুলি হল এমন জায়গা যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তরুণেরা মিথস্ক্রিয়া করে, বন্ধুত্ব এবং একত্রিত হওয়ার অনুভূতি জাগায়।
আবারও বিপাকে ইরমান খান, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
কুকি এবং মেইতেই সম্প্রদায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপে জড়িত, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বোঝাপড়ার প্রচার করে। এই কথোপকথনগুলি ভিন্নতা দূর করতে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণ ভিত্তি তৈরি করতে সহায়তা করে। এই গোষ্ঠী দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধনকে শক্তিশালী করতে এবং শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্ব নিরসনে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।
এটা লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণযে সুসম্পর্কের এই দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও কুকি ও মেইতিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধের ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়েছে। ইতিবাচক বিষয় হল তাদের কথাবার্তা ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার দৃষ্টান্তগুলি মণিপুর ও অন্যান্য রাজ্যুগুলির কাথে মডেল হিসেবে তুলে ধরা জরুরি। একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য বোঝাপড়া আর সম্নান জরুরি।
মণিপুরের কুকি এবং মেইতি সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট চাহিদা এবং উদ্বেগগুলি বোঝার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। অন্তর্ভুক্তি, বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ন্যায়সঙ্গত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকার এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটি সুস্থ ও সুরেলা সম্পর্ক গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখতে পারে।
রাজ্য সরকারকে অবশ্যই কুকি-মেইতেই সম্পর্ক উন্নত করার জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাপড়া, পুনর্মিলন এবং সহযোগিতাকে উন্নীত করতে হবে।
(পল্লব ভট্টাচার্যঃ প্রবীণ আইপিএস অফিসার, পুলিশের প্রধান ছিলেন। অসম পুলিশ সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন)