সংক্ষিপ্ত
প্রথমে ব্লগার খুন, সেখান থেকে ধৃত ব্যক্তিকে পাকড়াও করে আটক বাংলার এক শিক্ষক। সেই শিক্ষকের সূত্র ধরে ভারতজুড়ে কীভাবে ছড়িয়ে আছে জঙ্গিদের জাল?
আল কায়দা জঙ্গি সন্দেহে এবার পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার করা হল ২০ বছর বয়সী এক কলেজ-ছাত্রকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের বাসিন্দা মনিরুদ্দিন খান নামের ওই ছাত্রকে রবিবার গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স। এসটিএফ দাবি করেছে, বাংলাদেশের আল কায়দার ভারতীয় দল (আল কায়দা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা AIQS) জঙ্গি সন্দেহে এর আগে যে শিক্ষক আজিজুল হককে ধরা হয়েছিল, তাকে জেরা করেই উঠে এসেছে মনিরুদ্দিনের নাম। জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের হাতে ওই ছাত্র তুলে দিয়েছিল নিজের পরিচয়পত্র ও নথি। তার পরিচয়পত্র কাজে লাগিয়েই জঙ্গিদের সিম কার্ড ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় আল কায়দার প্রচার ও স্লিপার সেল তৈরি করার উদ্দেশ্যে ওই ছাত্র জঙ্গি নেতাদের সাহায্য করত বলে অভিযোগ পুলিশের।
বাংলাদেশে ব্লগারকে খুন করার অভিযোগে ধৃত ফয়জলকে গ্রেফতার করে কলকাতা-সহ সারা দেশজুড়ে আল কায়দার ভারতীয় দলের বিস্তারিত জাল সম্পর্কে অনেক তথ্যের সন্ধান পেয়েছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। ফয়জলকে জেরা করে উত্তরপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করা হয় হাসনত নামের আরেক ব্যক্তিকে। এই ব্যক্তির মালদহের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হয় একটি পেনড্রাইভ। আল কায়দা জঙ্গি সংগঠন যে ভারতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে খুন ও অনেকগুলি শহরে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেছে, তার বিশদ প্রমাণ পাওয়া গেছে উদ্ধার হওয়া পেনড্রাইভে। এই ঘটনায় জড়িত ছিল ভোপালের জেলে থাকা আরও দুই জঙ্গি। তাদেরও পরে ভোপাল থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।
এই দুই জেলবন্দি জঙ্গি আবার পুলিশের জেরার মুখে পড়ে মথুরাপুরের বাসিন্দা আজিজুল হকের সন্ধান দিয়ে দেয়। পুলিশের তথ্যে জানা গেছে, দক্ষিণ ২৪ পরগণায় স্লিপার সেল তৈরির কাজ শুরু করেছে আল কায়দা সংগঠন। সেই কাজের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে শিক্ষক আজিজুল। এই শিক্ষকের কাজ ছিল, বাংলাদেশ থেকে যেসমস্ত জঙ্গিরা ভারতে ঢুকবে, তাদের ভুয়ো ভারতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দেওয়া এবং ভারতের অন্দরে তাদের বসবাসের ঠাঁই জোগাড় করে দেওয়া। তার সাহায্য নিয়েই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় আল কায়দা নতুন মডিউল তৈরির ছক কষেছিল বলে জানা গেছে।
এসটিএফের আধিকারিকদের মতে, ধৃত আজিজুল মথুরাপুর অঞ্চলে আরবি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। তার কাছে প্রধানত নাবালক ছাত্রছাত্রীরাই পড়াশোনা করতে আসত। তারা ছাড়াও, এলাকার বেশ কয়েকজন উঠতি বয়সী ছাত্রের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে আজিজুল। তাদেরও ভাষা শিক্ষার ক্লাস শুরু হয়। মথুরাপুরের রানাঘাটা গ্রামের বাসিন্দা মনিরুদ্দিন খান ছিল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, দক্ষিণ বারাসতের একটি কলেজের ইতিহাসের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করত মনিরুদ্দিন। তার সঙ্গে ২০২১ সালে যোগাযোগ হয় শিক্ষক আজিজুল হকের। তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে পড়াতে শুরু করে আজিজুল। মণিরুদ্দিনের বাবা মজফ্ফর খান চালের গুঁড়োর ব্যবসা করেন। তাঁর দাবি, ছেলে শিক্ষকের কাছে পড়তে যেত বলে তাঁরাও কেউ কখনও তাকে বারণ করেননি। কিন্তু, তিনি জানিয়েছেন, গত প্রায় ৭ মাস ধরে আজিজুলের সঙ্গে তাঁর ছেলের কোনও যোগাযোগ ছিল না।
এসটিএফ সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় আল কায়দা বা আকিস বিভিন্নভাবে নেটওয়ার্ক তৈরি করছে কলকাতা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে। আজিজুলের মতো শিক্ষকদের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের নেতারা এসে বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা যোগাযোগ করছে, তাদেরকে জঙ্গি কার্যকলাপের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ও নানাবিধ উপায়ে দেশের বিরোধিতা করার পাঠ শেখাচ্ছে। এরপর এই ধরনের শিক্ষকরাই মগজধোলাই হয়ে যাওয়ার পর সাংঘাতিক হয়ে পড়ছে, তারা এরপর নিজের ছাত্রদের মগজধোলাই করছে। মৌখিকভাবে নাশকতার প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। কীভাবে বিস্ফোরক তৈরি করতে হয়, সেই পদ্ধতির বিস্তারিত নথিও তুলে দেওয়া হচ্ছে এইসব ছাত্রদের হাতে।
নিরীহ ছাত্রদের শেখানো হচ্ছে, তাদের বন্ধুদের কাছে মৌখিকভাবে বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আল কায়দা সংগঠনের প্রচার করতে। ছাত্রদের আল কায়দার অন্দরে নিয়োগ কীভাবে করতে হবে, তার ছকও কষে ফেলেছে এই জঙ্গিরা। এসটিএফের মতে, আজিজুল প্রথমে তার ছাত্র মনিরুদ্দিনকে জঙ্গি-পাঠ দেয়, এরপর তার কাছ থেকে আধার কার্ডের কপি নেয়। মনিরুদ্দিনের পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একাধিক সিমকার্ডে কিনে নিয়েছিল জঙ্গিরা। সেই নম্বরেই যোগাযোগ করত বাংলাদেশের জঙ্গি নেতারা। বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে‘টেরর ফান্ড’ ঢোকা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।
তদন্তের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পেরে গিয়েছিল যে, আজিজুল গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই মনিরুউদ্দিন গা ঢাকা দিয়েছে। যদিও তার বাবা মজফ্ফর খান জানিয়েছেন, মনিরুদ্দিন কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। সেজন্য তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর আর এক ছেলে, যে কলকাতার অন্য একটি নামী কলেজের ছাত্র, তাকে তলব করে জেরা শুরু করে এসটিএফ। শনিবার মনিরুউদ্দিন নিজেই এসটিএফের দফতরে হাজির হয়ে যায়। তাকে গ্রেফতার করে রবিবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়। তার জামিনের বিরোধিতা করেন সরকারি আইনজীবী অরূপ চক্রবর্তী। তাকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। ধৃতকে জেরা করে জঙ্গি নেটওয়ার্কের বড় মাথাদের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ।
আরও পড়ুন-
প্রতিবেশীর ঝামেলার জেরে খুন করে বস্তাবন্দি করে ফেলা হল মাতৃহারা ছোট্ট শিশুকে, বালুরঘাটের ঘটনায় এলাকাজুড়ে অশান্তির আগুন
‘পুলিশি চালানের মাধ্যমে কোষাগারে রাজস্ব তুলছে রাজ্য সরকার’, টুইটারে সোচ্চার শুভেন্দু অধিকারী
ব্যাগ থেকে টাকা ‘চুরি’-র দোষারোপ, খাস কলকাতায় বীরভূমের যুবককে মারতে মারতে মেরেই ফেলল ৬ আততায়ী