সংক্ষিপ্ত
টুইটারের প্রাক্তন সিইও জ্যাক ডোরসের সাক্ষাৎকারের পর থেকেই প্রবল বিতর্ক। রোজ সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলো ধরা করা হচ্ছে ডোরসেকে। এবার টুইটার ও ডোরসের দ্বিচারিতার উদাহরণ দিতে কলম ধরেছেন বিজেপি-র জাতীয় মুখপাত্র প্রেম শুক্লা।
প্রেম শুক্লা, জাতীয় মুখপাত্র, বিজেপি-- জ্যাক ডোরসে যেভাবে সাক্ষাৎকারে মিথ্যা অপবাদ ভারতের উপরে চাপিয়েছেন তা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। টুইটারের ইতিহাসের দিকে একবার যদি তাকানো যায়, তাহলে বারবার সামনে আসবে যে কীভাবে এই ডিজিটাল অনলাইন মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক সৌহাদ্যের বাতাবরণকে নষ্ট করার প্রক্রিয়া চালিয়েছে। এবং কিছু বিশেষ রাজনৈতিক মনোভাবাপন্ন লোক এবং রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এরা চুপ করে থেকে গিয়েছেন। আসলে এটাই টুইটারের নীতি। জ্যাক ডোরসে নিজেই সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন যে তাঁদের কর্মীদের মধ্যে একটা বড় অংশই বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। টুইটারের প্রাক্তন কর্তার এই বয়ানই প্রমাণ করে দেয় যে টুইটার কতখানি একটা একতরফা মনোভাব রাখা সংস্থা। যার জন্য কেউ এদের বিপরীতে সামান্য কিছু বলে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া হয়। টুইটার কি তাহলে দাবি করবে যে এটাই আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা?
ডোরসে যে নিজেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধ্বজাধারী বলে দাবি করছেন, তিনি নিজেই টুইটারের সিইও থাকাকালীন একাধিক অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করেছিলেন। এটা হয়েছিল ২০১৬ সালে আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। এমনকী একজন স্বনামধন্য জাতীয়বাদীর অ্যাকাউন্টও সেই সময় সাসপেন্ড করেছিল টুইটার। যিনি টুইটারে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে দেশদ্রোহী বলে ডেকেছিলেন। এই সময়ই অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের ৭টি অ্যাকাউন্টও সাসপেন্ড করিয়েছিলেন ডোরসে। এরপর এবিভিপি প্রতিবাদে নামলে সেই সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়েছিল।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ডেরসেকে একটি অ্যান্টি-হিন্দু প্ল্যাকার্ডের ছবিও পোস্ট করে দেখা গিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, ব্রাহ্মণের সম্মান ও গরিমাকে গুড়িয়ে দাও। যদিও, ডোরসে পরে যুক্তি দিয়েছিলেন যে সব পক্ষের কথা শুনেই এই পোস্টটা করা হয়েছিল। যদিও, দলিত আন্দোলনের এক কর্মী ডোরসের এই মন্তব্যকে খারিজ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন আসলে ওই পোস্টারের মধ্যে দিয়ে ভারতের জাত-পাতের বিভেদের সমস্যার কথা বলেছিল। কংগ্রেসের তৎকালীন অন্যতম শীর্ষ নেতা মণীশ তিওয়ারি জাতপাতের এই ভাবাবেগে আবার আগুন জ্বালানোর ইন্ধন দিয়েছিলেন তাঁর মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে। আর সেই মন্তব্যে মণীশ বলেছিলেন, ব্রাহ্মণরা হল ভারতের নতুন ইহুদি। আমাদের এর সঙ্গে বাস করার পদ্ধতি রপ্ত করে নিতে হবে। কংগ্রেসের এই মন্তব্য সাফ দেখিয়ে দিয়েছিল যে জ্যাক ডোরসে-র এক বিভ্রান্তকর মিথ্যা মন্তব্যকে কীভাবে তারা শিলমোহর দিয়েছিল।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ট্রু ইন্ডোলজি (True Indology) বলে পরিচিত এক ইতিহাসবিদের অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছিল টুইটার। কারণ, ওই ইতিহাসবিদ এনডি টিভি-ক একটি প্রতিবেদনে ভুল ধরেছিলেন। এনডি টিভি তাদের প্রতিবেদনে কাশ্মীর নিয়ে একটি ভুল তথ্য দিয়েছিল। তারা দাবি করেছিল কাশ্মীরে বরাবরই সম্প্রীতি ও সৌহাদ্যের পরিবেশ বজায় থেকেছে। এই তথ্য ঠিক করার জন্য টুইটারে পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই ইতিহাসবিদ। ট্রু ইন্ডোলজি (True Indology) বলে পরিচিত ওই ইতিহাসবিদ এনডি টিভি-কে উদ্দেশ্য করে স্মরণ করাতে চেয়েছিলেন কাশ্মীরের বুকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা হওয়ার ঘটনাকে এবং সেই সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছিলেন যে কীভাবে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় একজনও হিন্দু নেতাকে নির্বাচিত হতে দেখা যায় না- সেই বিষয়টি। টুইটাপ জানিয়েছিল ওই ইতিহাসবিদ নাকি ঘৃণা ছড়াচ্ছেন তাদের প্ল্যাটফর্মে এবং এই ধরনের উক্তি করার মধ্যে দিয়ে তিনি নাকি টুইটারের নীতিও ভঙ্গ করেছেন। একটি সত্যি ঘটমার অবতারণ করা কীভাবে ঘৃণা ছড়ানোর পর্যায়ে পড়তে পারে তা টুইটার-ই একমাত্র উত্তর দিতে পারে। আমার কথা হচ্ছে যদি আগামিকাল কোনও ইহুদি তাদের উপর হওয়া গণহত্যা নিয়ে কথা বলে তাহলে কি টুইটার এক্ষেত্রে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ আনবে!
যারা ডানপন্থী-তাদের নিয়ে বরাবরই সমস্যা হয়েছে টুইটারের। সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা রক্ষা নিয়ে আলোচনার জন্য ২০১৯ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি টুইটার কর্তাকে সংসদ ভবনে আলোচনায় উপস্থিত থাকতে সমন পাঠান তৎকালীন তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। কিন্তু গরহাজির থাকেন টুইটার কর্তা। অনুপস্থিতির কারণ দর্শাতে গিয়ে টুইটার জানিয়েছিল যে--- সমন পাঠানো এবং হাজির থাকার মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব কম হওয়ায় কেউ হাজির হতে পারছেন না। এরপর টুইটারকে ১০ দিনের অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল ৭ ফেব্রুয়ারি এই মিটিং হবে, তার পরিবর্তে তা ১১ তারিখ করে দিয়েছিল ভারত সরকার।
২০২০ সালের অক্টোবরে জ্যাক ডোরসের নেতৃত্বাধীন টুইটার ভারত-বিরোধী কেলেঙ্কারিতে জড়ায়। এতে তারা ভারতের অবিচ্ছেদ অঙ্গ লেহকে চিনের অন্তর্ভুক্ত বলে মানচিত্রে তুলে ধরেছিল। এই নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল। ১৮ অক্টোবর জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা নীতিন গোখলে লেহ থেকে লাইভ করছিলেন। আর সেই লাইভে টুইটার লাইভ লোকেশনে লিখেছিল--- 'লেহ, জম্মু ও কাশ্মীর, পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না' নীতিন গোখলে যখন কুশক ভাকুলা বিমানবন্দরেও পৌঁছেছিলেন তখনও তিনি লোকেশন চেক করেছিলেন এবং তাতে দেখতে পান ওই জায়গাকেও চিনের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখাচ্ছে টুইটার। অন্যান্যরাও সেই সময় লেহ-র লোকেশন চেক করতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়েছিলেন।
টুইটারের কেলেঙ্কারির যে শেষ নেই, তার আরও প্রমাণ রয়েছে। ২০১৯ সালে দেখা যায় টুইটার তার ইউজারদের সম্পর্কিত ব্যক্তিগত তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা বলে একটি সংস্থাকে বিক্রি করে দিয়েছে। ফেসবুকে তথ্য ফাঁসের কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর টুইটারেরও কেলেঙ্কারি সামনে এসেছিল। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা বিশ্ব জুড়েই বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল রাজনৈতিক দলের জন্য কাজ করছিল। ফেসবুক ও টুইটারের কাছে পাওয়া তথ্যকে কাজে লাগিয়ে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ইউজারদের সামনে কারচুরি করা তথ্য তুলে ধরত যাতে ওই তথ্য দেখে মানুষ প্রভাবিত হয়। দেখা যায় একটা সময় রাহুল গান্ধীও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সিইও-র সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন নির্বাচনে কংগ্রেসের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। এমনকী দেখা যায় যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মূল সংস্থা স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিজ-এর সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের একটা চুক্তি ছিল। এর দ্বারাই প্রমাণিত যে টুইটারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই কেন কংগ্রেস রে রে করে তেড়ে আসে।
টুইটারের সেন্সরশিপ আরও মাত্রা ছাড়ায় ২০২০ সালের মে মাসে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট নিষিদ্ধ করবেন। কিন্তু, এই সিদ্ধান্ত যখন ঘোষণা হয় ততক্ষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর লায়াবিলিটি প্রোটকেশনকে নিয়ন্ত্রণ করে এক এক্সিকিউটিভ অর্ডার সই করে দিয়েছিলেন। এরপর বহু মাস পরে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে গিয়ে টুইটার শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের অ্যাকাউন্টকে ব্লক করেছিল। এর কারণ হিসাবে টুইটার বলেছিল যে ট্রাম্পের টুইটে হিংসা ছড়ানোর ইন্ধন রয়েছে। ট্রাম্পকে টুইটার নিষিদ্ধ করেছিল কারণ, অন্যরা কীভাবে তাঁর টুইটকে দেখছে তার জন্য। সকলকে আরও একটা কথা স্মরণে আনা উচিত, যে তালিবানরাও কীভাবে আফগানিস্তানের সরকারের দখল নেওয়ার আগে কীভাবে টুইটারে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
ডোরসে স্বীকার করেছিলেন যে টুইটার কীভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের ই-মেল যাতে না পড়তে পারেন। তাদের মনে হয়েছিল এই ই-মেল যদি টুইটারে ভাইরাল হয়ে যায় তাহলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাবিত হতে পারে ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী ফলাফল।
টুইটারের এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে বরাবরই সরব থেকেছে ভারত। এমনকী ২০২১ সালেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর কড়া ভাষায় টুইটারকে বার্তা দিয়েছিলেন। রাজীব বলেছিলেন, '২০২১-এর জানুয়ারিতে প্রতিবাদ মিছিলকে ঘিরে বহু ভুয়ো খবর ছড়ানো হয়। এমনকী, আন্দোলন প্রতিরোধে গণহত্যার যে তত্ত্ব টুইটারে ভাইরাল করা হয়েছে তা ভুয়ো। আর এই ধরনের ভুয়ো খবর যে কোনও সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম থেকে সরাতে বদ্ধপরিকর ভারত সরকার।'
টুইটারের কর্মপদ্ধতিত বলে দিচ্ছে যে .তারা কতটা একতরফা মনোভাব নিয়ে চলে। একটা আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের এমন একতরফা মানসিকতা রাখা উচিত নয়। তাদের এই কর্মকাণ্ড মত প্রকাশের স্বাধীনতার টুটি চিপে ধরেছে। পাকিস্তান থেকে একজন ইসলাম নিয়ে একটু অন্য ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করায় টুইটার তাড়াহুড়ো করে ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছিল। এমনকী মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে রসিকতা করায় লরেন বোয়েবাট নামে এক মহিলার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছিল টুইটার। অথচ সরকার দ্বারা সতর্ক করা বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট যেখানে ঘৃণা থেকে শুরু করে হিংসা ও ভুয়ো তথ্যের আদান-প্রদান করা- সেই গুলো কোনও দিনই বন্ধ করেনি টুইটার। সুতরাং এমন এক সংস্থায় কাজ করা জ্যাক ডোরসে যে পুরোপুরি মিথ্যে বলবেন তা আশ্চর্যের কি আছে।
লেখক পরিচিতি-- প্রেম শুক্লা হলেন বিজেপি-র জাতীয় মুখপাত্র, এখানে তিনি যে মতামত ব্যক্ত করেছেন, সেটা তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত মতামত। এর সঙ্গে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার কোনও যোগাযোগ নেই।