সংক্ষিপ্ত

  • তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ভারতবর্ষের অন্যতম রাজনৈতিক নাট্যকার গিরিশ করনাড চলে গেলেন
  • কী অবিধায় মৃত্যুর পরে তাঁর যাত্রাপথের জয়গানকে ভূষিত করা যায় জানা নেই

প্রথমেই কি লিখব, 'সব মরণ নয় রে সমান'? নাকি লিখব, 'মানুষের মৃত্যু হলে তবু মানব থেকে যায়'? তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ভারতবর্ষের অন্যতম রাজনৈতিক নাট্যকার গিরিশ করনাড চলে গেলেন। কী অভিধায় মৃত্যুর পরে তাঁর যাত্রাপথের জয়গানকে ভূষিত করা যায়, জানা নেই।

১৯৬০-এর দশক থেকে নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে করনাড খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে ওঠেন কন্নড় নাটকের প্রধান মুখ। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমালেও শিকড় তাঁর কখনও ছিঁড়ে যায়নি। অন্তত পাঁচটি ভাষায় সাবলীল হলেও মাতৃভাষাই ছিল তাঁর প্রধান পছন্দ। করনাডের আজীবনের কাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর নিজস্ব ভাষাসংস্কৃতির সঙ্গে নাছোড় সম্পর্কের ওপরেই।

গিরিশ করনাডের প্রথম নাটক 'যযাতি' লেখা অক্সফোর্ডে বসে। যুবক গিরিশ পিতৃতন্ত্র, বর্ণভেদ নিয়ে সরব হন প্রথম নাটকেই। তবে আক্ষরিক শোরগোল পড়ে যায় তার পরবর্তী নাটক 'তুঘলক'-কে নিয়ে। তুঘলকের মানসিক অস্থিরতা, সন্দেহ, কূটনীতি এই সবকে গিরিশ আসলে আধুনিকতার আয়নায় পড়তে চেয়েছেন। গিরিশের নিজের কথায়, তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, 'অস্তিত্ববাদী ও নাস্তিক' তুঘলককে, অস্থিরতা আর উন্মত্ততাই যার প্রধান ঐশ্বর্য।সলিল বন্দ্যোপাধ্যায় বা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে বারবার সেই নাটকের মঞ্চায়ন দেখেছে বাঙালি। বাঙলা কেন, গোটা দেশেরই আজও তুঘলকি কারবারের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে পাশাপাশি রেখে পড়তে অসুবিধে হয় না।
 
শঙ্খ ঘোষ গিরিশ করনাডের 'হয়বদন' নাটকটির বঙ্গানুবাদ করেন। বহুরূপী পত্রিকায় ছাপা হয় সেই নাটক। পদ্মিনীর শরীরে তাঁর নিজস্ব অধিকার এবং দেবদত্ত ও কপিলের বাহাসই ছিল এই নাটকের কূট। দৈনন্দিন জীবনের ঈর্ষা, যৌনতা, টানাপোড়েনকে স্তম্ভ করে আরও একবার ইতিহাসের দূরবীনে দেখতে চেয়েছিলেন গিরিশ। 

এ বিষয়ে মূল খবরঃ চলে গেলেন গিরিশ করনাড, সংস্কৃতি জগতে নক্ষত্রপতন

গিরিশ করনাডের নিজস্ব নাট্যপৃথিবীতে কখনও ছাপ ফেলতে পারেনি ইওরোপ। বরং ভারতীয় সংস্কার, লোকায়ত জীবন, মিথ এগুলিকেই রূপকের মধ্যে দিয়ে বারবার ধরেছেন গিরিশ। সাপ, ঘোড়া, পুতুলের মতো লোকায়ত চিহ্নগুলি বারবার উঠে আসে গিরিশের নাটকে। অথচ সমসময়কে কুয়াশা কাটিয়ে সেই নাটকের ভিতরেই আবিষ্কার করতে বেগ পেতে হয় না।

শুধু নাটকই নয়। গিরিশের রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় ছবিতেও। ১৯৭০ সালে 'সংস্কার' ছবিটিতে গিরিশ অভিনয় করেন। বি পট্টভীরমার ছবিটির ডায়লগ লিখেছিলেন গিরিশ। ছবিটিতে সেই সময় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে জাতপাতের মত বিষয়কে। সে বছর জাতীয় পুরস্কার পায় ছবিটি। ভারতীয় টেলিভিশনের মাইলফলক 'মালগুডি ডেজ;-এ তাঁর অভিনয় মনে রেখেছে সারা নব্বইয়ের কিশোর-কিশোরীরা। অভিনেতা গিরিশ সব সময়ে নিজেকে ভাঙতে ভালবাসতেন গিরিশ। ২০১৭  সালে 'টাইগার জিন্দা হ্য়ায়'-এর মতো মূলধারার ছবিতেও তাঁকে সাবলীল অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। এই জনপ্রিয় ছবিটিই তাঁর শেষ বড়পর্দায় অভিনয়।

শুধু নাটক লেখা বা অভিনয়ই নয়। গিরিশের বেঁচে থাকাটাই ছিল আদ্যন্ত রাজনৈতিক। গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন,  ' আর্বান নকশাল' প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন প্রকাশ্য দিবালোকে। কোনও চাপই টলাতে পারেনি তাঁর স্বাধীন বেঁচে থাকার আর্তিকে। লোকসভা ভোটের মুখে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ভোট দিতে ডাক দিয়েছিল লেখক শিল্পী সংঘ। সেখানেও পুরোহিতের ভূমিকা নেন গিরিশ। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল তাঁর মজ্জাগত অভ্যেস। রবীন্দ্রনাটকের  সমালোচনা করে অনেকের রোষে পড়েছেন। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে একচুল নড়েননি। 

নাটকের সাম্রাজ্যকে রেখে, নিজস্ব রাজনীতির দুর্লভ গুণাগুনকে মরপৃথিবীতে রেখেই গিরিশ করনাড ৮১ বছর বয়সে অনন্তধামে চললেন। গেরুয়া ভারতে রইল তাঁর দীর্ঘ এক ছায়া।