নকশাল কমান্ডার: ৪০ বছর ধরে জঙ্গলে 'লাল সন্ত্রাস'-এর মুখ হয়ে থাকা ভূপতি হঠাৎ কীভাবে নত হল? অমিত শাহের আবেদন নাকি মৃত্যুর ভয় তার অস্ত্রের দম্ভ ভেঙে দিয়েছে? ১০ কোটি টাকার পুরস্কারপ্রাপ্ত মাওবাদী কমান্ডারের আত্মসমর্পণের পেছনের আসল গল্পটা কী? 

গড়চিরোলি (মহারাষ্ট্র): দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক মাওবাদী কমান্ডারদের মধ্যে অন্যতম মাল্লোজুলা ভেনুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি অবশেষে অস্ত্র সমর্পণ করেছে। ৪০ বছর ধরে জঙ্গলে 'লাল সন্ত্রাস' ছড়ানো এই দুর্ধর্ষ নকশাল নেতা এখন পুলিশের সামনে নতজানু। ভূপতি তার ৬০ জনেরও বেশি সঙ্গী, একে-৪৭ এবং ইনসাস রাইফেল সহ ৫০টিরও বেশি অস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিতে এই আত্মসমর্পণকে নকশাল বিরোধী অভিযানের জন্য একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কে এই ভূপতি, যে ৪০ বছর ধরে মাওবাদী নেটওয়ার্ককে বাঁচিয়ে রেখেছিল?

ভূপতি অর্থাৎ মাল্লোজুলা ভেনুগোপাল রাও, বয়স ৬৯ বছর। একসময় এই নাম পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আতঙ্কের আরেক নাম ছিল। সে নিষিদ্ধ সংগঠন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল—এই সংগঠনটিই সারা দেশে নকশাল হামলার পরিকল্পনা করত। ভূপতিকে সোনু, সোনু দাদা, অভয়, মাস্টার, বিবেক এবং ভেনু সহ অনেক নামে ডাকা হতো। মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে তার মাথার ওপর ১০ কোটি টাকারও বেশি পুরস্কার ছিল।

সে ১৯৮০-র দশকে পিপলস ওয়ার গ্রুপ (PWG)-এর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে পুরো "রেড করিডোর"-এ সন্ত্রাসের মুখ হয়ে ওঠে। সে সিপিআই (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনেরও সদস্য ছিল, যা নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলার কৌশল নির্ধারণ করত।

ভূপতির ওপর কত পুরস্কার ছিল এবং কেন সে সবচেয়ে ওয়ান্টেড ছিল?

  • ভূপতির ওপর বিভিন্ন রাজ্যে মোট ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।
  • তার নাম সেইসব মাওবাদী কমান্ডারদের মধ্যে আসে যারা সিআরপিএফ, এসটিএফ এবং ডিআরজি-র মতো নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হওয়া মারাত্মক হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত।
  • গড়চিরোলি এবং আবুঝমাদের মতো এলাকায় সে বেশ কয়েকবার নিরাপত্তা বাহিনীকে নিশানা বানিয়েছিল।
  • তার পরিকল্পনা এবং কৌশল এতটাই নিখুঁত ছিল যে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে তাকে ধরা প্রায় অসম্ভব মনে হতো।

ভূপতির বিরুদ্ধে এত মামলা কেন ছিল?

ভূপতির বিরুদ্ধে অনেক রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার ষড়যন্ত্র এবং তা কার্যকর করার অভিযোগ রয়েছে। গড়চিরোলি, ছত্তিশগড় এবং তেলেঙ্গানায় হওয়া কয়েক ডজন হামলায় তার দলের হাত ছিল। সিআরপিএফ, এসটিএফ এবং ডিআরজি-র অনেক জওয়ান তার হামলায় শহীদ হয়েছেন। মহারাষ্ট্র-ছত্তিশগড় সীমান্তে সে বহু বছর ধরে মাওবাদী ফ্রন্ট সামলেছে এবং গ্রামীণ এলাকায় সন্ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল।

আপনি কি জানেন ভূপতি কার ভাই?

  • খুব কম লোকই জানে যে ভূপতি কুখ্যাত মাওবাদী নেতা কিষেনজির ভাই।
  • কিষেনজি অর্থাৎ মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে এক সংঘর্ষে নিহত হয়েছিল।
  • দুই ভাই মিলে ১৯৮০-র দশকে "পিপলস ওয়ার গ্রুপ" তৈরি করেছিল, যা পরে সিপিআই (মাওবাদী) হিসেবে রূপ নেয়।
  • অর্থাৎ, ভূপতি শুধু একজন কর্মী নয়, মাওবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুখও ছিল।

ভূপতি আত্মসমর্পণ কেন করল? 

ভূপতির আত্মসমর্পণের পিছনে দুটি বড় কারণ বলা হচ্ছে- 

  1. বাড়তে থাকা নিরাপত্তা চাপ: গড়চিরোলি, আবুঝমাদ এবং ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে ক্রমাগত চলতে থাকা মাওবাদী-বিরোধী অভিযানে ভূপতি এবং তার দল চারদিক থেকে ঘিরে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের সি-৬০ কমান্ডো, তেলেঙ্গানা পুলিশ এবং কেন্দ্রের বিশেষ বাহিনী মাওবাদীদের নেটওয়ার্ক প্রায় ভেঙে দিয়েছিল।

২. সংগঠনের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ: ভূপতি এখন হিংসার পথ ছেড়ে শান্তি আলোচনার কথা বলছিল, কিন্তু তার কথা সংগঠন প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে ভেতরে ভেতরে বিরোধিতা এবং ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবশেষে সে তার সঙ্গীদের বলে- "এখন আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ বাকি আছে।"

অমিত শাহের আবেদন কি প্রভাব ফেলেছিল?

হ্যাঁ। এপ্রিলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশের সমস্ত আন্ডারগ্রাউন্ড নকশালদের অস্ত্র ছেড়ে মূল স্রোতে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। শাহ পরিষ্কার বলেছিলেন- “৩১ মার্চ ২০২৬-এর আগে আমরা ভারতকে নকশালবাদ থেকে মুক্ত করব।” ভূপতি এই আহ্বানের পরেই আত্মসমর্পণ করার মনস্থির করে। অনেক সূত্রের মতে, শাহের এই নীতি মাওবাদী এলাকায় একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে।

নকশালবাদ কি শেষ হতে চলেছে?

গড়চিরোলির মতো এলাকা, যেখানে একসময় মাওবাদীদের রাজত্ব ছিল, সেখানে এখন উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের ঢেউ বইছে। ভূপতির স্ত্রী বিমলা চন্দ্র সিদাম ওরফে তারকাও এক বছর আগে আত্মসমর্পণ করেছে। এটি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে মাওবাদী মতাদর্শ এখন শেষ হয়ে আসছে এবং জঙ্গলে বন্দুকের জায়গায় এখন স্কুল, রাস্তা এবং কর্মসংস্থানের কথা হচ্ছে। ভূপতির আত্মসমর্পণ শুধু একজন ব্যক্তির নয়, একটি মতাদর্শের পতনের প্রতীক। সেই ভূপতি, যে একদিন 'লাল বিপ্লব'-এর স্বপ্ন দেখেছিল, সে এখন 'শান্তি'-র পথে ফিরে এসেছে।