সংক্ষিপ্ত

তালিবানদের আফগানিস্থান বিজয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী আগ্রাসন। যার হাত ধরে ব্যক্তিগত জীবনেও ঢুকে পড়বে ধর্মীয় গোঁড়ামির আঁচ। 
 

ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য - সংবাদ মাধ্যমের সৌজন্যে তালিবান অধিকৃত কাবুলে যে বিভীষিকাময় দৃশ্য দৃশ্যত হল, তা বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতেও পৃথিবী চাক্ষুষ করেনি। উড়ন্ত আতশবাজির থেকে ছিটকে পড়া স্ফুলিঙ্গের মতো চলন্ত বিমান থেকে আছড়ে পড়ছে জীবন রক্ষার তাগিদে খড়কুটোর মতো উড়োজাহাজকে আঁকড়ে ঝুলে থাকা রক্তমাংসের মানুষ। উল্কাপাত, নক্ষত্র পতনকে অতিক্রম করে জলজ্যান্ত মানব পতন! সাধের প্রাণ ভোমরাটুকু বাঁচানোর অদম্য অভিপ্রায়ে! কারও ভাবনার চৌহদ্দিতেও কখনও এসেছিল নাকি! জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা কতটা বিপন্ন মনে হলে তবেই না মানুষ এমন দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিতেও কসুর করে না! 

গত ১৬ই অগাস্ট, ২০২১ কাবুল পতনের সাথে সাথেই আফগানিস্তানে দ্বিতীয় দফায় তালিবানি শাসনের পত্তনের সূচনা পর্ব নিশ্চিত হল। তালিবান শব্দটির প্রতিশব্দ হল ‘ছাত্র’। নিজেদের ‘ইসলামের একনিষ্ঠ ছাত্র’ বলেই তালিবানরা নিজেদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে এসেছে। সেহেতু, ইসলামের দোহাই দিয়ে তাঁদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় কোথাও এতটুকুও খামতি নেই। যার অকাট্য ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের সজ্জায় অবাধ ধর্মীয় আভরণের আস্তরণ। মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের বর্ম চাপানো। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই বা কেন! আমাদের ‘বহুজন হিতায় চ, বহুজন সুখায় চ’র এই দেশেও কি বিগত কয়েক বছর ধরে একই প্রচেষ্টার তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে না! কিন্তু ধর্মের আকুল স্থান তো হওয়ার কথা ছিল মানব মননের নির্মল আত্মায়। 

"

মানুষ যা কিছু ধারণ করে সেটাই হল তাঁর ধর্ম। তাই মানুষ অন্তরের কষ্ট, দুঃখ, খেদ, কামনা, বাসনা … সব কিছুই নিবেদন করে তাঁর প্রার্থিত ঈশ্বরের কাছে।  এমনকি অন্তরের মুক্তিরও অন্বেষণ চালায় ধর্মীয় আকুতির বিশ্বাসের জোরেই। তাতে মত ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সকল ধর্মেরই পথ মিলিত হয়েছে একই গন্তব্যের সুলুকসন্ধানে। যেহেতু সমাজ জীবনে যুক্তিগ্রাহ্য আইন প্রণয়নের বহুকাল আগে থেকেই ধর্মের উপস্থিতি, সেহেতু মানব জীবনকে সুসংবদ্ধ করার প্রাথমিক কাজটুকু সম্পন্ন হয়েছিল ধর্মের হাত ধরেই। পরবর্তীকালে যুক্তিগ্রাহ্য আইন প্রণয়ন ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পন্ন আর্থসামাজিক তত্ত্ব আবিষ্কার ও প্রয়োগের ফলস্বরূপ সমাজ জীবনে ধর্মের গ্রীবা অনেকাংশেই খর্ব হয়েছে। তাই আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মের কেন্দ্রস্থলই হল মানুষের আত্মার অন্দরে। সুতরাং, আধুনিক সুসভ্য জগৎসংসারে ধর্ম থাকার কথা মানুষের বিশ্বাসের আশ্রয় স্থল জুড়ে। অথচ, ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাজনীতির কারবারিদের যুগলবন্দীর কারসাজিতে রাষ্ট্রীয় গড়নে ব্যবহৃত হতে লাগলো ধর্মের নির্লজ্জ প্রয়োগ। ধর্ম যেহেতু মানুষের আত্মার গভীরে সম্পৃক্ত, সেহেতু ধর্মের নামে মানুষকে অবলীলায় প্ররোচিত করতে ধর্মীয় মৌলবাদকেও খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। তাই বিশ্ব জুড়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের প্রয়োজনে যত্রতত্র ‘ধর্ম যুদ্ধের’ হাঁকডাক। কিন্তু বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালিত কোন দেশ কি এযাবৎ কাল পর্যন্ত ‘জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ লাভ করতে পেরেছে? বৈজ্ঞানিক যুক্তির থেকে ধর্ম অধিকতর বিশ্বাসধর্মী উপাদানে সমৃদ্ধ। ধর্ম মানুষের ঐকান্তিক বিশ্বাসের প্রশয়ে পরম যত্নে লালিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সমৃদ্ধ এবং যুক্তিগ্রাহ্য কখনই হতে পারে না। অথচ, পৃথিবী জুড়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে আধার করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রতন্ত্র নির্মাণের জন্যই এত হিংস্রতা, এত বর্বরতা, অশ্রুজলের বন্যায় মিশে থাকা এত রক্তস্রোত।

আফগানিস্থানের প্রেক্ষিতে একথা প্রবলভাবে সত্য যে, দীর্ঘদিন ধরে চলা দুঃসহ গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভিন রাষ্ট্রের ধারাবাহিক হস্তক্ষেপ এবং বিদেশী শক্তির মদতে ক্ষমতাসীন পঙ্গু ও দুর্নীতিগ্রস্থ দেশজ সরকার আম আফগানীদের মনে ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণার পাহাড় পুঞ্জীভূত করে ফেলেছিল। অন্যদিকে, প্রথম দফার নৃশংস, বর্বর, পৈশাচিক তালিবান রাজ আফগানী জনমানসে চরম ভীতি ও আতঙ্ক বিস্তার করে রেখেছিল। ফলস্বরূপ, জনসাধারণের মনে গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছিল প্রবল অস্থিরতা ও সিদ্ধান্ত হীনতার থাবা। তাই একদিকে যেমন আশরাফ ঘানি নেতৃত্বাধীন পুতুল সরকারের প্রতি আম আফগানদের চরম অনাস্থা স্তূপীকৃত হয়েছিল। তেমনি অন্যদিকে, বর্বরতা ও পৈশাচিকতার প্রবল আঁধারে তাঁদের আশ্চর্য সুন্দর দেশটা চাপা পড়ে যাবে জানা সত্ত্বেও নৃশংস তালিবানদের রোখার তাগিদে আফগান জনগণের এককাট্টা প্রতিরোধের সম্ভাবনাও কার্যত অসম্ভব ছিল। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই তালিবান নেতৃত্ব এমন একটি মওকার অপেক্ষায় খুর ঠুকছিল। তাঁরা বিলক্ষণ জানতো যে, তাঁদের সংগঠিত আক্রমণকে রোখার মতো না ছিল সরকারী শক্তির মনোবল, না ছিল আম আদমির ঐক্যবদ্ধ প্রত্যাঘাতের ক্ষীণতর সম্ভাবনা। যার নীট ফল হল, প্রায় বিনা বাধায় তালিবানদের আফগানিস্তানের রাজনৈতিক মসনদে প্রত্যাবর্তন।           

তালিবানদের এই আফগানিস্থান বিজয় শুধুমাত্র একটি সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা পুনর্দখলের উপাখ্যান নয়। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী আগ্রাসন। যে মৌলবাদী আগ্রাসনের হাত ধরে একান্ত ব্যক্তিগত নাগরিক জীবনেও অবধারিতভাবে ঢুকে পড়বে ধর্মীয় গোঁড়ামির হিংস্র অগ্নিবলয়ের আঁচ। আর তাতে ছারখার হয়ে যাবে তিলতিল করে গড়ে ওঠা সভ্য সমাজ জীবনের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শক্তির ঔদ্ধত্যে বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তির মতো এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে অন্য মত ও পথের যাবতীয় স্মৃতিচিহ্ন। তালিবানি অনুশাসন ভঙ্গকারীদের মধ্যযুগীয় বর্বরতার উল্লাসে পাথর ছুঁড়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হবে। চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হবে মহিলাদের স্বাধীনতা ও আত্মসন্মান। ধর্মীয় অনুশাসনের মুখোশে প্রতি পদে ভূলুণ্ঠিত হবে মানুষের মৌলিক অধিকার।     

আরও পড়ুন - আমরুল্লা সালে - 'চিরকালের গুপ্তচর' এখন নিজেই আফগান প্রেসিডেন্ট, পঞ্জশির প্রতিরোধের মুখ

আরও পড়ুন - তালিবানদের উৎখাতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে 'পাঁচ সিংহে'র উপত্যকা - জড়ো হচ্ছে নর্দান অ্যালায়েন্স

আরও পড়ুুন- Afghanistan - 'পাকিস্তানের গ্রাস করার কিংবা তালিবানদের শাসনের পক্ষে অনেক বড় দেশ'

তৃতীয় বিশ্বের একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত গরীব দেশ ও তার আপামর জনগণকে আদিম বর্বরতার অন্ধকারাচ্ছন্ন বলয়ে আচ্ছাদিত হতে দেখেও প্রায় নিশ্চুপ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের ধনী ও বলশালী দেশগুলো। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে নিত্তিতে মেপে দেখছে নিজেদের লাভ ও ক্ষতির আনুপাতিক হার। রাষ্ট্রপুঞ্জও তথৈবচ। আতঙ্কে ছুটোছুটি করছে ভীত সন্ত্রস্ত আম নাগরিকেরা। তালিবানদের পদধ্বনির ভয়াল তরঙ্গে আতঙ্কিত মহিলারা দরজার কপাট আটকে সম্পূর্ণ গৃহবন্দী। অবোধ শিশুর সারল্যের চৌদিকে কেবলই আগ্নেয়াস্ত্রর লেলিহান ঝঙ্কার। অস্তমিত নারীর অস্তিত্ব। বিপন্ন শৈশব। বিপর্যস্ত মানবাধিকার। তবু থমকে মানবতা। কাবুল বিমানবন্দরে ডালা বন্দী ক্রন্দনরত দুধের শিশুটার মতো অসভ্যতার বন্দরে অবরুদ্ধ আম আফগানদের সম্মুখে আজ নিঃসীম শূন্যতা। শ্বেতশুভ্র বরফের ফোঁটা ঝরা পর্বত নগরী অচিরেই বধ্যভূমিতে রূপান্তরের আশঙ্কায় আজ তাঁরা প্রবল অসহায়, নিঝুম একা।

লেখক - অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস), সিমলা, হিমাচল প্রদেশ    


 

YouTube video player