সংক্ষিপ্ত

গুমনামী বাবা লিখেছিলেন, তাঁকে হত্যা করতেই হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলা করেছিল আমেরিকা। হামলার আগে কিন্তু বেশ কয়েকবার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গিয়েছিলেন ওই দুই শহরে।

শুক্রবার, ৭৬তম হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবস। ১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট এবং ৯ অগাস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। মুহূর্তে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হযেছিল জনবহুল দুই শহর। মৃত্য়ুর সংখ্যা কার্যত অগুনতি হলেও, ধরে নেওয়া হয় হিরোশিমায় মৃত্যু হয়েছিল ৭০,০০০ থেকে ১,৩৫,০০০ মানুষের। আর নাগাসাকিতে ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০। কিন্তু, এই গণহত্যা কি শুধুমাত্র একটি মানুষকে হত্য়া করার জন্য? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির যে নেতাকে একমাত্র খতম বা বন্দি করতে পারেনি মিত্রশক্তি - নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু?

হঠাৎ করে এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে গাঁজাখুড়ি মনে হতেই পারে। আসলে এরকম একটা প্রশ্ন তুলেছেন 'গুমনামী বাবা' বা উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের সাধু 'ভগবানজি'। যাঁর, জীবন-মৃত্যু - সবটাই রহস্য়ে ঘেরা। পর্দার আড়ালের বাইরে না আসা এই সাধু, অনেকের বিশ্বাসেই আর কেউ নন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বিশেষ করে নেতাজি অন্তর্ধান তদন্তের যে শেষ কমিশন বসেছিল, সেই মুখার্জি কমিশনের মাথা বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্য়ায়ও, আইনি বাধায় লিখতে না পারলেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন গুমনামী বাবাই নেতাজি - এমনটাই শোনা যায়। তবে তাঁর রিপোর্টও কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহন করেননি। 

"

যাইহোক, এবার আসা যাক পরমাণু বোমা হামলার প্রসঙ্গে। মুখার্জি কমিশনের তদন্ত চলাকালীন এবং অনুজ ধর, চন্দ্রচূড় ঘোষদের মতো নেতাজি গবেষকদের গবেষণায়, গুমনামী বাবা বা ভগবানজির লেখায় ১৯৪৫ সালের সেই পরমাণু বোমা হামলার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁকে হত্যা করার জন্যই ব্রিটিশদের চাপে পরপর দুটি জাপানি শহরে পরমাণু বোমা হামলা চালিয়েছিল আমেরিকা। এমনকী, ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন অধ্য়াপক অ্যালান কেইসলার-ও বলেছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুকে হত্য়া করার জন্যই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের চাপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জাপানে পরমাণু হামলা চালিয়েছিলেন। 

আরও পড়ুন - Hiroshima Day - নেতাজি আজও 'যুদ্ধাপরাধী', পরমাণু বোমা ফেলেও আমেরিকা কেন সাধু হবে

সত্যিই কী তাই? নেতাজি সংক্রান্ত গোয়েন্দা দফতরের ফাইল ভারতীয় সরকার এখনও প্রকাশ না করলেও, কী পরিস্থিতিতে আমেরিকা, জাপানে পরমাণু হামলা চালিয়েছিল, সেই সংক্রান্ত সব ফাইলই জনসমক্ষে রয়েছে। কী পাওয়া যাচ্ছে সেইসব ফাইল থেকে? 

ম্যানহাটন প্রজেক্ট, অর্থাৎ পরমাণু বোমা বানানোর প্রকল্পটি সামলাতো দুটি মার্কিন দফতর - যুদ্ধ দফতর এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দফতর। দুই দফতরের বিভিন্ন ফাইলই বলছে ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে, মার্কিন যে কমিটি এই হামলা পরিচালনা করেছিল, তারা পরমাণু বোমা ফেলার জন্য চারটি জাপানি শহর বেছে নিয়েছিল - হিরোশিমা, কোকুরা, নিগাতা এবং নাগাসাকি। কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল এই শহরগুলি? কারণ, জাপানের অন্যান্য শহরগুলি ততদিনে অন্যান্য বোমা হামলায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেই তুলনায় এই ৪টি শহরে সেভাবে বোমা ফেলেনি আমেরিকা। 

আরও পড়ুন - Hiroshima Day: ফিরে দেখা ভয়ঙ্কর সেই অতীত, পরমাণু বোমার ধ্বংসের ক্ষত বয়ে চলছে হিরোশিমা

মার্কিন সামরিক বাহিনী ভেবেছিল, আগে সেভাবে ক্ষতি না হওয়া এই শহরগুলিতে পরমাণু বোমা ফেললে জাপান সরকার সহজেই আত্মসমর্পণ করবে। মজার বিষয় হল, তার আগে সুভাষচন্দ্র বসুও, সম্ভবত ঠিক এই কারণেই অর্থাৎ টোকিওর বা অন্যান্য জাপানি শহরের মতো ক্ষতিগ্রস্ত নয় বলেই হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে গিয়েছিলেন। এবার দেখা যাক, হামলাগুলির দিন কী ঘটেছিল। হিরোশিমায় সুভাষ নেই জেনেই কি আমেরিকা ৩দিন পর ফের নাগাসাকিতে আক্রমণ করেছিল? 

মার্কিন ফাইল বলছে, ট্রুম্যান প্রশাসনের কাছ থেকে নির্বাচিত চারটি শহরেই দুটি বোমা ফেলার চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়েছিল। তবে, শেষ পর্যন্ত কোনদুটি শহর এর শিকার হবে, তা ঠিক করা ছিল সামরিক সিদ্ধান্ত। কীরকম? 

আরও পড়ুন - দিল্লি থেকে 'গায়েব' নেতাজির টুপির খোঁজ মিলল কলকাতায়, চন্দ্র বসুর অভিযোগ ওড়ালো মোদী সরকার

৬ অগস্ট সকালে, মার্কিন বাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিল হিরোশিমা। সেইসঙ্গে অন্য দুটি শহর বিকল্প হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। হিরোশিমাকে প্রাথমিক লক্ষ্য বাছার পিছনে মার্কিন বাহিনী কারণ দেখিয়েছে, সেই শহরেই মিত্রশক্তির কোনও বন্দি ছিল না। আবহাওয়া পরিস্থিতি পক্ষে থাকায় এনোলা গে বিমানের পাইলট কর্নেল পল টিবেটস, শেষ পর্যন্ত হিরোশিমাতেই বোমা ফেলেছিলেন। 

নাগাসাকির কিন্তু, পারমাণবিক বোমার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না, ছিল দ্বিতীয় বিকল্প। ৯ অগাস্ট মার্কিন বাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কোকুরা। মেজর চার্লস সুইনি কোকুরার আকাশে ওইদিন তিনবার প্রদক্ষিণ করেছিলেন। কিন্তু মেঘের জন্য প্রতিবারই শহরটি স্পষ্ট করে দেখতে পাননি তিনি। এর মধ্যে তাঁর বিমানের জ্বালানি পুরিয়ে আসতে থাকে। জাপানিদের চোখেও পড়ে যায় বিমানটি। এরপরই মেজর সুইনি উড়ে আসেন নাগাসাকির উপরে। মেঘের মধ্যে একটিমাত্র ফাঁক খুঁজে পেতেই ফেলেছিলেন দ্বিতীয় পরমাণু বোমা। ওই ফাঁকটি না থাকলে বোমাটি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হত, এমনই পরিকল্পনা ছিল মার্কিন বাহিনীর। 

স্পষ্টতই, সুভাষ বসুই পরমাণু বোমার লক্ষ্যবস্তু হলে, মার্কিন বাহিনী কোকুরার আকাশে উপরে এতটা সময় ব্যয় করে অভিযানকে বিপন্ন করতে চাইত না। আর হিরোশিমার আকাশে মেঘ থাকলে, হয়তো বেঁচে যেত হিরোশিমাও। সুভাষ বসুকে মারার জন্য পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা হলে, আমেরিকা এতসব যদি-কিন্তুর উপর নির্ভর করত না।   

নেতাজি গবেষক অনুজ ধর, চন্দ্রচূড় ঘোষ - যাঁরা মনে করেন ভগবানজি বা গুমনামী বাবাই নেতাজি, তাঁরাও কিন্তু সুভাস বসুকে মারার জন্যই হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছিল - এই তত্ত্ব বিশ্বাস করেন না। তাহলে কেন গুমনামি বাবা ওই কথা লিখে গিয়েছেন? অনুজ-চন্দ্রচূড়-রা এই বিষয়ে মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছিলেন। তাঁরা জানিয়েছেন, গুমনামী বাবার লেখাপত্রে যে অসঙ্গতি রয়েছে, তা পিটিএসডি (PTSD) বা পোস্ট ট্রমটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর লক্ষণ। পোস্ট ট্রমটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হল - কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় দুর্ঘটনা, সন্ত্রাসবাদী হামলা, যুদ্ধ বা ধর্ষণের মতো একটি মানসিক আঘাতের ঘটনার সম্মুখীন হলে বা প্রত্যক্ষ করলে এই ধরণের মানসিক ব্যাধি দেখা যেতে পারে। 

YouTube video player