যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার উত্তেজনা দেখা দেয়। ইজরায়েল সেনাবাহিনীর মতে, মঙ্গলবার সকালে ইরান ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বীরশেবার আবাসিক এলাকায় আঘাত হানে। এই হামলায় চারজন নিহত এবং প্রায় ২০ জন আহত হয়েছেন। 

দুই সপ্তাহ ধরে উত্তেজনায় জর্জরিত ছিল পশ্চিম এশিয়া। ইজরায়েল এবং ইরানের মধ্যে ১২ দিনের তীব্র সংঘর্ষের পর মঙ্গলবার ভোর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।

মঙ্গলবার ভোর ৪টায় ইজরায়েল আক্রমণ বন্ধ করেছে বলে ইরানের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে। ইরান সরকারের মিডিয়া অনুসারে, তারাও আক্রমণ বন্ধ করেছে। এরপর ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “যুদ্ধবিরতি কার্যকর, দয়া করে এটি ভঙ্গ করবেন না।”

তবে, যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার উত্তেজনা দেখা দেয়। ইজরায়েল সেনাবাহিনীর মতে, মঙ্গলবার সকালে ইরান ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বীরশেবার আবাসিক এলাকায় আঘাত হানে। এই হামলায় চারজন নিহত এবং প্রায় ২০ জন আহত হয়েছেন। গাড়ি পুড়ে গেছে। এই হামলার কারণে ইজরায়েল বেশ কিছু বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।

ইরানের হামলার প্রসঙ্গে, কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে সোমবার রাতে কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ছোটখাটো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। কাতারের মেজর জেনারেল শায়েক আল হাজরি জানিয়েছেন, ইরান মোট ১৯টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ট্রাম্পের মতে, ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি আটকানো হয়েছে।

ইরানের হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে কাতার। তারা দেশটিতে থাকা ইরানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কাতার, মিশর, সৌদি আরবের মতো দেশগুলি যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষের মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ইরান যদি আবার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে হাঁটে, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে তিনি জানিয়েছেন।

ইরাকের সামরিক ঘাঁটিতেও সোমবার রাতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। এই হামলায় উত্তর বাগদাদের ক্যাম্প তাজি এবং দিকার প্রদেশের ইমাম আলী ঘাঁটির রাডার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে পশ্চিম ইরাকের অন্যান্য স্থানে হামলা প্রতিহত করা হয়েছে বলে মার্কিন সেনাবাহিনী জানিয়েছে।

১২ দিনের সংঘর্ষে ইজরায়েল ও ইরান উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ইরানের হামলায় ২৪ জন ইজরায়েলি নিহত এবং ১০০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ইজরায়েলের পাল্টা হামলায় ৯৭৪ জন ইরানি নিহত এবং ৩৪৫৮ জন আহত হয়েছে।

এই যুদ্ধের সময় ইজরায়েলে থাকা মার্কিন নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে আমেরিকা। প্রায় ২৫০ জন আমেরিকানকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইজরায়েলে প্রায় ৭ লক্ষ আমেরিকান বসবাস করেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তাদের অনেকেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।

এদিকে, রাশিয়াও যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেসকভ বলেছেন, শান্তিপূর্ণ সমাধানই তাদের লক্ষ্য। এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হোক, এটাই তাদের কামনা। ট্রাম্পও যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি উভয় দেশকে তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করার এবং অবিলম্বে বিমান প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। হামলা অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

যুদ্ধ শেষ হলেও, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে, তাই শান্তি স্থায়ী করতে আরও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

যুদ্ধ কখন শুরু হয়েছিল?

২০২৫ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম এশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য) আবারও সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে চলা উত্তেজনা এবার সামরিক সংঘর্ষে রূপ নেয়। জুন ১১ তারিখে ইরানের অভ্যন্তরে পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতে ইজরায়েলের গোপন ড্রোন হামলার খবর প্রকাশিত হয়। প্রতিক্রিয়া হিসেবে জুন ১৩ তারিখে রাতে ইরান উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ইজরায়েলের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে এই অঞ্চলে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে।

১২ দিন ধরে হামলা হয়েছে?

এই ১২ দিনের যুদ্ধে উভয় পক্ষই ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছে। ইরান শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপ করেছে। বিশেষ করে বীরশেবা, অ্যাশদোদ, অ্যাশকেলন, হাইফার মতো ইজরায়েলের শহরগুলিতে আবাসিক এলাকায় ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। মৃত ও আহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইজরায়েল সেনাবাহিনীও ইরানের তেহরানের আশেপাশের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস (IRGC)-এর ঘাঁটিতেও হামলা চালানো হয়েছে।

জনগণের উপর প্রভাব

এই যুদ্ধের প্রভাব জনগণের উপর মারাত্মকভাবে পড়েছে। ইজরায়েলের হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর সবই সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ইরানের গাদিস, শিরাজ, খোরামাবাদের মতো শহরে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। জাতিসংঘের মতে, ইরানে ৩,৫০০ জনেরও বেশি আহত এবং ৯০০ জনেরও বেশি মারা গেছে। ইজরায়েলে ২৪ জন মারা গেছে এবং ১,০০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও, ইরানের সমর্থনে হিজবুল্লাহ, হামাসের মতো সংগঠনগুলিও ইজরায়েলে রকেট হামলা চালিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঙ্কার এবং নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

ট্রাম্পের ভূমিকা কী ছিল?

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হস্তক্ষেপ করেন। তিনি কাতার, সৌদি আরব, মিশরের মতো দেশগুলির সঙ্গে আলোচনা করেন। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। তবে এটিকে আমেরিকার সরকারি হস্তক্ষেপ না বলে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প টুইটারে লিখেছেন:

“ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দয়া করে এটি ভঙ্গ করবেন না। আপনাদের জনগণের জন্য এই চুক্তিকে সম্মান করুন।” ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টা সফল হয় এবং জুন ২৫ তারিখে ভোর ৪টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ইরানের বিদেশ মন্ত্রক এক বিবৃতিতে বলেছে, “ইজরায়েল হামলা বন্ধ করায় আমরাও প্রতিক্রিয়া বন্ধ করেছি।”