সংক্ষিপ্ত

চিরঘুমের দেশে শাঁওলি মিত্র, তবে চলে গিয়েও রয়ে গিলেন তাঁর নাটক-থিয়েটার অপরূপ সূষ্টির মধ্যে দিয়ে।  জীবনকালে খ্যাতি এত শীর্ষে উঠেও চলে যাওয়ার সময় কাউকে দেখা দিতে চাইলেন না তিনি।

চিরঘুমের দেশে শাঁওলি মিত্র ( Shaoli Mitra)। তবে চলে গিয়েও রয়ে গিলেন তাঁর নাটক-থিয়েটার অপরূপ সূষ্টির মধ্যে দিয়ে। জীবনকালে খ্যাতি এতশীর্ষে উঠেও চলে যাওয়ার সময় কাউকে দেখা দিতে চাইলেন না তিনি। প্রচার আলো থেকে দূরে সরে বটগাছের ছায়া নিবিড় পথে মিলিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আর তেমনটাই হল।

২০২০ সালে ৭২ বছর পূর্ণ হতেই শাঁওলি মিত্র এক ইচ্ছাপত্র লিখেছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর ইচ্ছাপত্রের সঙ্গে শম্ভু মিত্রের শেষ ইচ্ছাপত্রের সাদৃশ্য লক্ষনীয়। তিনি সেখানে জানিয়েছিলেন, আমি শাঁওলি মিত্র। ২০২০ সালে আমার বাহাত্তর বছর পূর্ণ হয়েছে। পরিণত বয়েসে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে আমি এই ইচ্ছাপত্র রচনা করেছি। কোনও বাধ্যবাধকতা নয়। আমি আশা করব, আমার মানস কন্যা অর্পিতা ঘোষ এবং পুত্র তুল্য় সায়ক চক্রবর্তী, যারা গত তিন বছর ধরে আমার সমস্ত দায়িত্ব বহন করে চলেছে, তাঁরা আমার এই ইচ্ছাপত্রের সম্মান দেবে।' সেখানেই তিনি বলেন, 'আমার পিতাকে অনুসরণ করেই,  আমার মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব আমার সৎকার সম্পন্ন করা হয়। ঐ শরীরটিকে প্রদর্শণ করায় আমার নিতান্ত সংকোচ। সামান্যভাবে সাধারণের অগোচরে যেনও শেষকৃত্যটি সম্পন্ন করা হয়।' উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে তাঁর বাবা শম্ভু মিত্রের মৃত্যুর পরও, একেবারে প্রচারের আলোর বাইরেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। একইভাবে শম্ভু মিত্রের কন্যা  শাঁওলি মিত্র ইচ্ছাপত্রে জানান যে, মৃত্যুর পর নিথর শরীর  প্রদর্শন করতে তাঁর সঙ্কোচ রয়েছে। জীবনকালে সায়ক চক্রবর্তী এবং অর্পিতা ঘোষ মানস পুত্র এবং মানস কন্যার কথাই উল্লেখ করেন তিনি। আর জীবনের অন্তিম সময়ে তাঁদের পাশে পেয়েছিলেন তিনি।  শেষকৃত্য় সম্পন্ন হওয়ার পরেই তাঁরা এই মর্মান্তিক খবর প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। 

প্রসঙ্গত, ভারতের স্বাধীনতার ঠিক পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন  শাঁওলি মিত্র। ছোট বেলা থেকেই সাহিত্য-নাটকের মধ্য দিয়েই তাঁরা বড় হয়ে ওঠা। কারণ শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্র তাঁর মা ও বাবার সঙ্গে থেকেই তিনি নাটকের সাহচার্য পেয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকটিতে অমলের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। এরপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজস্ব থিয়েটার গ্রুপ গঠন করেন, 'পঞ্চম বৈদিক।'  ২০১১ সালে রবীন্দ্র স্বার্ধ শতবর্ষ উদযাপন সমিতির চেয়ারপার্সন হিসেবে যোগ দেন  শাঁওলি মিত্র। শুধু নাথবতী অনাথবত নয় , পুতুলখেলা, একটি রাজনৈতিক হত্যা, হযবরল, গ্যালিলিওর জীবন, কথা অমৃতসমান- বাংলা থিয়েটারের জগতে চিরস্মরণীয় শম্ভু মিত্রের (Shambhu Mitra) কন্যার অবদান।  তিনি জীবনকালে কাজ করেছেন বহুরূপি প্রোডাকশনে। তবে  ঋত্ত্বিক ঘটক নির্মিত বাংলা ছবি  যুক্তি তর্ক গল্প-এ  বঙ্গবালা চরিত্রে অভিনয়, তাঁর সেই অবিস্মরণীয় কাজ সবাই মনে রাখবে। ২০০৩ সালে বাংলা থিয়েটারে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালে অভিনয়ে আজীবনকালের অবদানের জন্য তিনি বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারের মর্যাদা পান। ২০০৯ সালে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। জীবনকালে  ছবির পাশাপাশি গণনাট্য-নবনাট্য সহ একাধিক বই নিয়েও তাঁর অসামান্য কাজ সকলেই ফিরে ফিরে দেখবে। তবে শুধুই সাহিত্য-নাটক-ছবিতেই আটকে ছিলেন না তিনি। হেঁটেছিলেন বাংলার পরিবর্তন চাই-র পথেও।

তখন রাজ্যে দাপিয়ে চলছে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার। বামেদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেবের হাতে তখন মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ। এদিকে ২০০৮ সালের আশে পাশে তখন ফুঁসছে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনে বামেদের বিরুদ্ধে পরিবর্তন চেয়ে রাস্তায় নেমেছেিলেন শাঁওলি মিত্র। বলাইবাহুল্য তখনই তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করে। ২০১০ এও যখন বামেদের বিগ্রেট সফরে উপচে পড়া ভিড়, তখন কেউ ভাবেনি পরিবর্তনের ঢেউ বদলে দেবে রাজ্যের রাজনৈতিক রঙকেই। কিন্তু শেষ অবধি পরিবর্তনেরই জয় হয়। ক্ষমতায় আসে মমতার সরকার। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর শাঁওলি মিত্রকে প্রথমে রবীন্দ্র রচনাবলী দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১২ সালে মহাশ্বেতা দেবী বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতির দায়িত্ব ছাড়ার পর ভার নেন শাঁওলি মিত্র। তবে ২০১৮ সালে কাজ করার উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবের কথা উল্লেখ করে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তবে জীবন সায়াহ্নে এসে সব কিছু থেকেই দূরে সরে লাইম লাইটের থেকে বহূ দূরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন  শাঁওলি মিত্র।