সংক্ষিপ্ত
- কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দিল ওষুধ কোম্পানিগুলোকে
- ডাক্তারদের জন্য় আর পাঁচতারা বিলাসের বন্দোবস্ত করা যাবে না
- কিন্তু তাতে করে কি কাজের কাজ কিছু হবে
- প্রতিক্রিয়া দিলেন চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ডাক্তারদের জন্য় তারা পাঁচতারা হোটেলের বিলাসবহুল ব্য়বস্থা করতে পারবে না। সেইসঙ্গে কোম্পানির টাকায় ডাক্তারদের বেডাতে যাওয়ার ঐতিহ্য়েও ইতি টানতে হবে এবার।
মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা চেম্বারে গিয়ে ওষুধ বিলি করতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা আর আগের মতো ডাক্তারদের কোনও অনৈতিক সুযোগ সুবিধে দিতে পারবেন না। অর্থাৎ সোজা বাংলায়, ফার্মাসিউটিক্য়ালের টাকায় ডাক্তাররা আর দেশবিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না। প্রশ্ন উঠেছে, এর ফলে, চিকিৎসকদের সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির অশুভ আঁতাত কতটা কমবে? এশিয়ানেটের তরফে প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়েছিল চিকিৎসকদের। সেইসঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও। দেখে নেওয়া যাক তাঁরা কী বলছেন।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অসীম চট্টোপাধ্য়ায় দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরেই আর ওষুধ কোম্পানিগুলোর কোনও প্রোমোশনে যান না। তাঁর কথায়, "আমি এই ধরনের কিছু অ্য়াকসেপ্ট করি না। এমনকি স্য়ম্পেল হিসেবে যে ওষুধগুলো দেওয়া হয়, সেগুলোও আমি নিই না। তবে সরকার যে নিয়মের কথা বলছে, তাতে করে কিছু পাল্টাবে বলবে আমি মনে করি না। দেখুন, একজন লোক যখন ওষুধের দোকানে গিয়ে বলে আমাকে অমুক ট্য়াবলেট চারটে দিন, তখন সে-ও কিন্তু ডাক্তার নয়, যে দিচ্ছে সে-ও ডাক্তার নয়। আপনি দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পেট খারাপ হয়েছে কোন ওষুধ খেলে কমবে, তখন তাকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। আজকাল তো আবার অনলাইনে প্রেসক্রিপশন আপলোড করে ওষুধ কেনাবেচা চলছে। ধরুন, আমি হয়তো কোনও রোগীকে অল্পকিছুদিনের জন্য় অ্য়ালপ্রাজোলাম প্রেসক্রাইব করলাম। এবার ওই প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে সে কিন্তু পাতার-পর-পাতা ওই ওষুধ কিনে নিতে পারে। এখন কথা হল, ক-দিনের জন্য় ওই প্রেসক্রিপশন বৈধ থাকবে, কতদিনের জন্য় ওই ওষুধ দিয়েছি, তা-তো দেখার কেউ নেই। সমাজ চাইছে আমরা হোয়াটসঅ্য়াপেই ওষুধ লিখে দিই, সমাজ চাইছে অনলাইন প্রেসক্রিপশন করে দিই। পুরোটাই সমাজের ময়লা, সমাজকেই সাফ করতে হবে।"
পালমোনোলজিস্ট ডাক্তার চন্দন ঘোষ অবশ্য় ওষুধ কোম্পানিগুলো থেকে একটা পেন পর্যন্ত নিতে রাজি নন। তাঁর কথায়, "এ ব্য়াপারে তো আমি বিভিন্ন ফোরামে বলে আসছি। ডাক্তাররা গাছেরও কুড়োবে আবার তলারও কুড়োবে, এটা হতে পারে না। তাঁদের ন্য়ূনতম নৈতিকতা থাকলে কোনওরকম ঘুষ নেওয়া উচিত নয়। একটা পেন নেওয়াকেও আমি ঘুষ নেওয়া মনে করি, আবার ওষুধ কোম্পানির টাকায় পাঁচতারা হোটেলে থাকাকেও ঘুষ বলে মনে করি। আমার অঞ্চলের মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা জানেন, আমি কিছুই নিই না। এখানকার আইএমএতে আমি বলেছিলাম, তারা একটা প্রস্তাব নিন যে, আমাদের সদস্য়রা যেন কোনও অনৈতিক কাজে যুক্ত না-থাকে। তারা সেই প্রস্তাবটা নিতে ভয় পেয়েছিল। অবশ্য় পরবর্তীকালে বর্ধমান আইএমএ ওই প্রস্তাব নিয়েছিল। এটা বেশ কিছু বছর আগের কথা। এই ধরনের অনৈতিক সুযোগ সুবিধে নেওয়াতেই আমাদের ডাক্তারি পেশাটা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।" কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, এতে করে কতটা কী পাল্টাবে, কারণ আমরা অনেকেই তো ওভার-দ্য়-কাউন্টার ওষুধের দোকানে গিয়ে ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনি? ডা. ঘোষের স্পষ্ট কথা, " একজন ডাক্তারকে আগে ইনডিভিজুয়ালি কারেক্ট হতে হবে, তারপর তো এসব প্রশ্ন। আচ্ছা বলুন তো, একজন ডাক্তার পুজোর আগে কুড়িটা জামা অ্য়াকসেপ্ট করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর থেকে, এটা জেনেও যে ওই জামাগুলো না-সে নিজে পরবে, না কাউকে দিয়ে দেবে। নৈতিক অধঃপতন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে ভাবতে পারেন। সম্মান পেতে গেলে আপনাকেও কিছু ছাড়তে হবে। তবে স্য়াম্পেল ওষুধ নেওয়ার ব্য়াপারে আমি খারাপ কিছু দেখি না। কারণ, ওগুলো গরিব রোগীদের জন্য় কাজে লাগবে।" তাহলে তো ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভরা মনে করবেন, ডাক্তারবাবু যখন স্য়াম্পেল অ্য়াকসেপ্ট করছেন, তখন আমাদের ওষুধও লিখে দেবেন প্রেসক্রিপশনে? ডা. ঘোষ তা মানতে রাজি নন, "না, তা হবে না। কারণ ওই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ভাল করেই বুঝবেন, এই ডাক্তার সেই ডাক্তার নন, আমি বললেই যিনি ওষুধ লিখে দেবেন।"
পালমোনোলজিস্ট ডা. অশোক সেনগুপ্ত-র আবার অন্য়মত। তাঁর কথায়, "শুনেছি এই নিয়মটার কথা। একজন ডাক্তার হিসেবে কিছু বলাটা খুব ডেলিকেট। তবে বিষয়টা কী জানেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো এই ধরনের সুযোগ সুবিধেগুলো দিক বা দিক, আমাদের কিন্তু তাদের ওষুধ লিখে যেতেই হবে। আর এটাই হল প্য়ারাডক্স। আমরা বহুজাতিক দামি কোম্পানির ওষুধই লিখতে একপ্রকার বাধ্য়। কারণ , স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো কমদামে যে ওষুধ দিচ্ছে, তার গুণমান দেখার জন্য় খুব আঁটোসাটো কোনও ব্য়বস্থা নেই। বিদেশে কিন্তু সেই ব্য়বস্থা রয়েছে। এই সেদিন দেখলেন না, ছোটদের সাবান, শ্য়াম্পু,পাউডার প্রস্তুতকারী একটি ওষুধ কোম্পানিকে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হল। আমাদের দেশে ওষুধের গুণমান দেখার জন্য় যে ব্য়বস্থা আছে, তা অত্য়ন্ত ঢিলেঢালা। এখন আমি সেখানে একজন ক্রিটিক্য়াল পেশেন্টকে কোন ভরসায় নামি কোম্পানির ওষুধ ছেড়ে সস্তার কমদামি ওষুধ দেওয়ার ঝঁকি নিতে পারি বলুন তো?"
নাম না-করে পোড় খাওয়া এক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিভ বললেন, "এতে করে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আসলে সমস্য়াটা অন্য় জায়গায়। ধরুন একটি বিশেষ গ্রুপের অ্য়ান্টিবায়োটিক তৈরি করে দুটি সংস্থা। দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম সংস্থার ওষুধের গুণমান দ্বিতীয় সংস্থার চেয়ে অনেক ভাল। তা সত্ত্বেও দ্বিতীয় সংস্থার ওষুধটাই বাজারে বেশি বিকোচ্ছে। কারণ, প্রথম সংস্থা গবেষণার জন্য় বেশি ব্য়য় করে আর দ্বিতীয় সংস্থা ডাক্তারদের জন্য় বেশি বিনিয়োগ করে। এখন এই পরিস্থিতিতে কী হয়, দ্বিতীয় সংস্থার ওষুধটি দোকানে বেশি পাওয়া যায়। এবার যিনি চাইছেন প্রথম সংস্থার ভাল ওষুধটা প্রেসক্রাইব করতে, তিনিও অ্য়াভেলেভেলিটির কথা ভেবে দ্বিতীয় সংস্থার ওষুধটি প্রেসক্রাইব করেন।"
অতএব?
যা চলছে তেমনই চলবে।