সংক্ষিপ্ত

কোভিডের দ্বিতীয়বর্ষে একটা বড় ইস্যু ভোট।  বর্ষবরণের মাসে চলুন ফিরে দেখা যাক বছরটাকে ভোট-ভাইরাসের গ্রাফে।

 

কোভিডের দ্বিতীয়বর্ষে একটা বড় ইস্যু ভোট। একুশের শুরু তুলনামূলক ভালো হলেও মার্চ পেরোতেই বদলায় সংক্রমণের ম্যাপ। একদিকে ২০২১ সাল ছিল বিধানসভায় তৃণমূলের ভাগ্য-নির্ধারণের বছর। তাই সব সতর্কতা জেনে-বুঝেও কোথায় যেনও আলগা হয়ে যায় কোভিড বিধির সেফটিপিন। ওদিকে রাজ্য সরকারি বুলেটিনে শুধুই বাড়তে থাকে লাল ডটের সংখ্যা। ভোট বাজার যে কখন এসে ভাইরাসের সঙ্গে টেক্কা দিতে যায়, তা মনে নেই শহরবাসীর। কিন্তু চোখ এড়িয়েছিল কি কমিশনেরও, প্রশ্ন ওঠে রাজনৈতিক মহলে। তাই বর্ষবরণের মাসে চলুন ফিরে দেখা যাক বছরটাকে ভোট-ভাইরাসের গ্রাফে (Coronavirus and WB Election 2021)।

একুশ সালের তখন সবে জানুয়ারি মাস, রাজ্যে তখন দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা এগারোশোর আশেপাশে। একদিকে ২০২০ সালের প্রথম বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পেরিয়ে তখন সবে জিরিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। উত্তরবঙ্গে বেশ নেমে এসেছে কোভিড গ্রাফ। কলকাতা -উত্তর ২৪ পরগণা তখন ২৫০ এর আশে পাশে দৈনিক কোভিড সংক্রমণ। এরপর একমাস পেরিয়েছে। পয়লা ফেব্রুয়ারি ম্যাজিকের মতো দৈনিক সংক্রমণ নেমে আসে ১৭৯। কলকাতা -উত্তর ২৪ পরগণা তখন ৪০ এর আশে পাশে দৈনিক কোভিড সংক্রমণ। এদিকে তখনও জানে না রাজ্যবাসী ঠিক কী অপেক্ষা করছে পরের মাসগুলিতে। কতটা হাহাকার হতে পারে হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে। সোনার থেকেও দামী হওয়ার সম্ভাবনায় অক্সিজেনের সিলিন্ডার। 

আরও পড়ুন, EC on KMC Polls: কলকাতার ১১৩৯ বুথকে স্পর্শকাতর ঘোষণা, বিধি লঙ্ঘনে কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি কমিশনের

কারণ একুশের এই শান্তিপূর্ণ ফেব্রুয়ারির কোভিড বুলেটিন গ্রাফটা বদলাতে সময় নেয় ঠিক ২ মাস। আগের রেকর্ড ব্রেক করা শুরু করে নিঃশব্দেই।  তখন আওয়াজ বাড়ছে শুধুই তৃণমূলের একের পর এক উইকেটে। দলে দলে ঘাসফুল ছেড়ে যাচ্ছেন বিজেপিতে। ওদিকে যারা কোভিড নিয়ে ঘর ছাড়ছেন, তাঁদের অনেকেই হাসপাতাল থেকে ফিরতে পারেননি। ভোট দেওয়া তো দূর হস্ত। আট দফা ভোটের দামামা ততদিনে বেজে গিয়েছে। রাজ্য জুড়ে সারাদিনে শয়ে শয়ে সভা। মিটিং-মিছিল। ওদিকে সমান্তরালে বাড়ছে কোভিড গ্রাফ। পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্যে থেকে না আসলেও, তৃণমূলের কথায় 'বহিরাগতরা' তখন বাংলার বুকে স্টেজে-স্টেজে প্রচারে ঝড় তুলছেন। রাজ্যকে ৫ ভাগে ভাগ করে পরিসংখ্যান নিয়ে সমীক্ষায় নেমেছে ততদিনে গেরুয়া শিবিরের 'পঞ্চপাণ্ডব'। 

রাজ্যের শাসকদল কিংবা বিরোধী দল প্রত্যেকেই ব্য়স্ত নিজেকে প্রমাণ করতে। জনজোয়ারে ছাপিয়ে যাচ্ছে তখন তৃণমূলের 'খেলা হবে'। ওদিকে তখন বাবুলের, 'এই তৃণমূল আর নয়-আর নয়', বাজছে তারস্বরে। 'আর নয় অন্য়ায়', কর্মসূচি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে জেলা সফরে গেরুয়া রথ। আর এই প্রচার থেকে ৮ দফার ভোটের মাঝেই ইয়োর্কার ছোড়ে নিশব্দে কোভিড ভাইরাস। কারণ ততদিনে সে ২০২০ সালের থেকেও পরিপক্ক। জিনের গঠন বদলে আরও বেশি শক্তিশালী। তাই শুধু জ্বরই নয়, হালকা-পাতলা নিঃশ্বাসে কষ্ট নয়, একবারে দারুণভাবেই ফুসফুসে আঘাত করছে সে। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তখনও কয়লাকাণ্ড-গরুপাচারকাণ্ডই শিরোণামে। ভোটের দোরগড়ায় কেন্দ্রীয়বাহিনীর চাপে ততদিনে দল ছেড়ে বিজেপি-তে রাজ্যের রোমান্টিক কাপল্ শোভন-বৈশাখী।

ফোন না ধরা, দিলীপের মুখে 'ডাল-ভাত' কম্বিনেশন শুনে শোভন-বৈশাখী বেজায় চটে গেলেও বিজেপি ছেড়ে তখনও কেউ যায়নি। এদিকে একেরপর এক হেভিওয়েট নেতা-বিধায়াককে হারানোর পর তখন তৃণমূলকে নিয়ে চিন্তায় কমজোরি বিরোধীরাও। আর ততদিনে প্রচার শেষ, দীর্ঘ ৮ দফার ভোটও শেষের পথে। শুরু হয়েছে কোভিডের হাহাকার। না, তখনও সেই সময়টায় কোনও সরকারি আমলার কোভিড পজেটিভ ছেলে ভূল করে এয়ারপোর্টের কথা না মেনে, শহর ঘুরে বেড়ায়নি। তবে কোভিড সংক্রমণ ফেব্রুয়ারিতে এত কমে গিয়েও এত বাড়ল কী করে এপ্রশ্নের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে সব রাজনৈতিক দলকেই।

মে মাসে তখন উলটপূরাণ। গ্রাফে শুধু তির্যক করে এতদিন নিঃশব্দে উপরে উঠল  কোভিড-১৯। তবে এবার গ্রাফে তির্যক, তৃণমূলের ভোটের রেখাও।  বিপুল ভোটে জয়   তৃণমূলের। ভিন রাজ্যের যাতায়াত কমে। গুরুত্ব বাড়ে আর-টিপিসিআর-র। 'বিজয় মিছিল বন্ধ, কোভিড কমানোই লক্ষ্য', তৃণমূলের তৃতীয়বারের সরকার গঠন করে বলেন মমতা। রাতারাতি জেলায়-জেলায় অক্সিজেন প্রোডাকশন সিস্টেমের ইউনিট পাঠান। এদিকে তখন অনেক ভোটে হেরে ফুঁসছে বিজেপি।এরপরেই উঠে আসে উড়িষ্যায় অক্সিজেন সরবারহ প্রসঙ্গ। চাহিদা পূরণের দাবি জানায় মোদী সরকার। এদিকে সেই দাবি পূরণ করতে গেলে নড়ে যাবে নিজেই পশ্চিমবঙ্গ, জানায় মমতার সরকার। 

গ্রীষ্মের দাবদাহ ততদিনে মানুষ ভূলে গিয়েছে। কারণ ততদিনে কোভিড লাফিয়ে বাড়ছে রাজ্যে। বাড়ছে কনটেইমেন্ট জোনের সংখ্যা। আর তারই সঙ্গে খবর ছড়ায়, যোগী রাজ্যের নদী থেকে কোভিডের অর্ধেক পোড়ানো দেহ ভেসে আসছে গঙ্গা হয়ে বাংলার বুকে। জল থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে প্রচার শুরু করেছে রাজ্য সরকার। তৃতীয়বারের সরকারে এসে অনেকটাই তখন চাপ হালকা। যতোই উপনির্বাচন থাক। অনলাইন পড়াশোনার মতো, ভার্চুয়ালের সভায় মন দিয়েছে রাজনৈতিক নেতারাও। কিন্তু সেসব বোধয় অনেকেই দেখে যেতে পারেননি। নিজের ওয়ার্ডের জয় দেখে যেতে পারেননি খড়দার তৃণমূল প্রার্থী কাজল সিনহা সহ আরও ভিনজেলার আরও অনেকেই। 

ভোট-ভাইরাস গ্রাফ পুজোর পরে অনেকটাই বদলেছে। কোভিড পরীক্ষার কীটের অভাবে একসময় যারা পরীক্ষা করাতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে যারা বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই পরে পেয়েছেন ভ্যাকসিন বটে। আর এবার একে একে উপনির্বাচনে ফের বিপুল জয়ের পর রাত পেরোলেই পুরভোট। কোভিডের নয়া বিধিও জারি করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কারণ নতুন পথের পথিক এবার যে ওমিক্রণ।