সংক্ষিপ্ত

  • নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে আবিস্কার হয় পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন
  • আকস্মিক ভাবেই আবিষ্কার হয়েছিল লাইসোজাইম
  • মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার অস্ত্র
  •  প্রথমবার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ইঁদুরের উপর সফল প্রয়োগ হল পেনিসিলিনের

তপন মল্লিক- পেনিসিলিন আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব নিয়ে গোঁড়া থেকেই একটা টানাপড়েন ছিল। ৯২ বছর আগে নিতান্ত এক ঘটনায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং তাঁর ল্যাবরেটরিতে আবিস্কার করে ফেলেন পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে যেদিন স্কটল্যান্ডে নিজের কাজে যোগ দিলেন, তখন পুরো ল্যাবরেটরি ধুলোময়। পরিষ্কারের পর কাজ শুরু করে তিনি খেয়াল করলেন, তাঁর পেট্রি ডিশে (একধরনের ছোট গোল স্বচ্ছ পাত্র) রাখা কালচার করা স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাক্টেরিয়ার উপর ছাতা পড়ে গেছে আর ছাতা পড়া অংশের ব্যাক্টেরিয়াদের মৃত্যু ঘটেছে। 

তার সহযোগী মার্লিন প্রাইসের  কাছে  নিয়ে গেলেন সেই ডিশ। তখন প্রাইস বললেন- এভাবেই তো আপনি লাইসোজাইম আবিষ্কার করেছিলেন। বছর পাঁচেক আগেও এভাবে ব্যাক্টেরিয়া কালচারে ব্যস্ত ছিলেন ফ্লেমিং। সেদিন সর্দি হয়েছিল তাঁর। কাজের ফাঁকে সর্দির একফোঁটা গিয়ে পড়েছিল ডিশে। পরে দেখা গিয়েছিল জীবানুর বংশবৃদ্ধি রোধ করেছিল সেই সর্দির ফোঁটা। সেই ফোঁটা থেকেই আবিষ্কার হয়েছিল লাইসোজাইম; আকস্মিক ভাবেই। কিন্তু এবার! কিন্তু এবার  কে মেরে ফেলল তাদের?
ফ্লেমিংয়ের আগে প্রাণরসায়নবিদ আর্নেস্ট চেইন ১৯৩৮ সাল থেকে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন কীভাবে মানুষের শরীরের উপযোগী একটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা যায়। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে আমেরিকার কানেকটিকাটের নিউ হ্যাভেন হাসপাতালের রোগী অ্যান মিলারের ওপর সফলভাবে পেনিসিলিন প্রয়োগ করলে সে বেঁচে যায়। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার জীববিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরিও পেনিসিলিন আবিস্কারে অবদান রেখেছিলেন। যে কারণে ১৯৫৫ সালে এই তিন চিকিৎসাবিজ্ঞানীকে যৌথভাবে নোবেল দেওয়া হয়।  
১৯২৯-এর ব্রিটিশ জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথোলজিতে ফ্লেমিং তাঁর গবেষণা কথা প্রকাশ করলেন। Penicillium notetum নামক ছত্রাক থেকে প্রাপ্ত সেই রাসায়নিকের ফ্লেমিং নামকরণ করলেন পেনিসিলিন। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ সরাসরি মারা গিয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল ক্ষতস্থানে সংক্রমণের ফলে। পেনিসিলিন বদলে দিল সব। ১৯৩৯ সাল নাগাদ ফের পেনিসিলিন নিয়ে আগ্রহী হলেন কিছু গবেষক। প্রায় অন্ধকার থেকে তাঁর খুঁজে আনলেন ফ্লেমিংয়ের আর্টিকলটিও।
প্রথমেই লর্ড হাওয়ার্ড ওয়াল্টার ফ্লোরে। তাঁর নেতৃত্বই তৈরি হল পেনিসিলিন টিম। মিত্রশক্তিকে তাঁরা শেষমেশ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে পেনিসিলিনও এক অস্ত্র, মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার অস্ত্র। কিন্তু ততদিনে হিটলারের উন্মত্ত ইহুদি ক্রোধ সে দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা তছনছ করে দেয়। বহু ইহুদি বিজ্ঞানী দেশ ছেড়ে ভয়ে পালান। দেশ ছাড়েন আর্নেস্ট চেন।
পালিয়ে এলেন ইংল্যান্ডে পকেটে মাত্র ১০ পাউন্ড‌ নিয়ে। তাঁকে সাহায্য করেন জে.বি.এস হলডেন ও স্যার ফ্রেডরিক গোল্যান্ড হপকিন্স। চেন ও রসায়নবিদ এডোয়ার্ড আব্রাহামের প্রথম কাজ ছিল পেনিসিলিনের বিশুদ্ধকরণ ও ঘণীকরণের সঠিক পদ্ধতিটি আবিষ্কারের। তাঁদের পদ্ধতিটির থেকে অনেক বেশি কার্যকর পদ্ধতির প্রয়োগ করে এরপর পাদপ্রদীপে আসেন নর্মান হিটলি।
১৯৪০-এ মে মাসে প্রথমবার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ইঁদুরের উপর সফল প্রয়োগ হল পেনিসিলিনের। সেই তথ্য ফ্লোরে ও চেন প্রকাশ করলেন ল্যান্সেট পত্রিকায়। পুলিশকর্মী অ্যালবার্ট আলেকজান্ডার মুখে গোলাপের কাঁটায় ছড়ে গিয়ে সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। ১৯৪১-এর ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর উপর প্রয়োগ হল পেনিসিলিন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তিনি। 
কিন্তু মানবদেহে পেনিসিলিনের ডোজের ধারণা নেই তখন। পর্যাপ্ত পেনিসিলিনের অভাবে মারা গেলেন পুলিশকর্মীটি। এরপরই বিপুল পরিমাণে পেনিসিলিন উৎপাদনের জন্য সাড়া না পেয়ে ফ্লোরে চললেন আমেরিকা, সঙ্গে হিটলি।
আমেরিকার ল্যাবোরেটরিতে হিটলি পেনিসিলিন উৎপাদন পদ্ধতির আরো উন্নতিতে লেগে পড়লেন। সঙ্গী হলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন মেয়ার। এই মেয়ারই পরবর্তীতে হিটলিকে এড়িয়ে পেনিসিলিনের পেটেন্ট নেন ওষুধ কোম্পানি মার্কের সঙ্গে। এদিকে প্রচুর বাণিজ্যিক উৎপাদনে দরকার ওষুধের কোম্পানিগুলির সহায়তা। পরে আমেরিকার বহু কোম্পানি এগিয়ে এল সাহায্যে। 
তবে ১৯৪৫-এর শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল অবশ্য পেলেন ফ্লেমিং, ফ্লোরে ও চেন তিনজনেই, পেলেন না হিটলি চারজনকে একসাথে নোবেল না দেওয়ার অদ্ভুত নিয়মে।