সংক্ষিপ্ত

  • সঙ্গীতশিল্পীর গানের ভক্ত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী
  • গান্ধীজী নিজে শুভলক্ষ্মীকে অনুরোধ করেছিলেন
  • গানটি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গাইতে
  • সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি

প্রিয় শিল্পীর গান শুনতে এক দরিদ্র দম্পতি বহু দূর থেকে থেকে সেই সকালের রওনা দিয়েছেন।  অনেকটা পথ তাদের যেতে হবে পায়ে হেঁটে মাদুরাই। কিন্তু যখন অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছলেন তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয় কতৃপক্ষের কাছে শুনলেন ওনার গান খানিক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এ কথা শুনে স্ত্রী কেঁদে ফেললেন। এতটা আশা নিয়ে এতটা পথ পায়ে হেঁটে আসা তবে বিফলে গেল? কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লেন।  শরীরে তখন আর কোনও শক্তি নেই! স্বামী বললেন, দেখি কি করা যায়। অনেক খোঁজখবর করে শিল্পী কোথায় থাকেন, কতটা পথ যেতে হবে, কি ভাবে যাবেন সব জানলেন। জানা গেল উনি কাছাকাছি একটি জায়গায় একজনের বাড়িতে উঠেছেন। 

আরও পড়ুন- প্রথম বাঙালি হিসেবে একশো বছর আগে শরৎচন্দ্র নিজেও কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, জানুন সেই অজানা কাহিনি

অনেক কষ্টে সেই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করলেন। পথঘটের হাল হদিসও জেনে বুঝে নিলেন। তারপর ফের অবসন্ন শরীর নিয়ে হাটা শুরু করলেন। বেশ অনেক রাত্রে সেই বাড়ির সামনে হাজির হলেন সেই দম্পতি। নিরাপত্তা রক্ষীকে অনেক বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ির ভিতরে ঢোকা গেল। কিন্তু বাড়ির লোক জানালেন, উনি এইমাত্র শুতে গিয়েছেন, ভীষণ ক্লান্ত। ভদ্রলোক অনুনয় বিনয় করে বললেন, একবার ডেকে দিন, অনেক দূর থেকে এসেছি, অনেক আশা নিয়ে। অনেক অনুরোধের পর শিল্পীকে ডাকা হল। উনি এসে সব শুনলেন। তারপর ওনার স্ত্রীকে বললেন, কেঁদো না, বোসো, আমি আসছি। শিল্পী অবশেষে এলেন, একটা নয়, পরপর বেশ কয়েকটা গান শোনালেন। এদিকে রাত তখন প্রায়  একটা বাজে। শ্রোতা দম্পতির কিছু খাওয়াও হয়নি, ফিরে যাওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। শিল্পী অতিথিদের খাওয়া দাওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। তারা তাদের প্রিয় শিল্পীর গান শুনে সেখানে রাতে থাকলেন। সেখানেই থেকে যেতে বললেন। 

সেদিনের ওই শিল্পীর নাম এম এস শুভলক্ষ্মী। কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পীর গানের ভক্ত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী।   একবার গান্ধীজী নিজে শুভলক্ষ্মীকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ গানটি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গাইতে।  শুভলক্ষ্মী সেই অনুরোধ প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি গানটা জানতেন না। সে কথা শুনে গান্ধীজী বলেছিলেন,  সুর ছাড়াও যদি তিনি শুধু আবৃত্তিও করেন, তাহলেও শুনতে চাইব।  গানটা জেনে অন্য কেউ গাওয়ার চেয়ে ওনার আবৃত্তিও হবে আশ্চর্য ঘটনা। মহাত্মা গান্ধী ওর কণ্ঠস্বরকে বলতেন মীরার কণ্ঠস্বর। শুভলক্ষ্মীর কন্ঠে গান্ধীজির খুব প্রিয় ভজন ছিল 'হরি তুম হরো'। কি আছে শুভলক্ষ্মীর গানে? তাঁর নিজের ভাষায়, সঙ্গীতের উদ্দেশ্য হল সঙ্গীতের অতীত যে সত্তা তাকে প্রকাশ করা। কিশোরী আমোনকর শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠস্বরকে বলতেন অষ্টম সুর। শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠে অসামান্যভাবে জেগে উঠেছে বিভিন্ন মরমী সাধকের পদাবলী। দক্ষিণ ভারতের ত্যাগরাজের অসামান্য সব রচনা, যার মধ্যে 'ভাবয়ামী রঘুরামম্', 'বন্দমু রঘুনন্দনম্'  অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ ছাড়া তুলসীদাসের 'তু দয়াল দীন হুঁ', মীরার 'মেরে তো গিরিধর গোপাল’, সুরদাসের 'হে গোবিন্দ রাখো শরণ' কবীরের 'ভজ রে ভাইয়া রাম গোবিন্দ হরি' মনে হয় এ যুগেও হারিয়ে যায় নি। 

আরও পড়ুন- রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে স্কুলে নোটিশ দিয়েছিলেন, সেরা ছাত্র হয়েও শান্তিনিকেতনে স্বস্তি পাননি

গায়িকা-নায়িকা যুগে দক্ষিণ ভারতের কিংবদন্তি কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী এমএস শুভলক্ষ্মীর সিনেমায় অভিনয় এবং গান গাওয়া রীতিমতো ঐতিহাসিক ঘটনা।  নাগপুরের লিবার্টি প্রেক্ষাগৃহে ‘মীরা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। মীরা' ছবিটি দুটি ভাষায় হয়েছিল। শুভলক্ষ্মী মীরার ভূমিকায় অভিনয় করেন। সবামীর পত্রিকা ‘কল্কি’র তহবিল সমৃদ্ধ করতে অল্প বয়সের শুভলক্ষ্মী ‘সাবিত্রী’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। অধিকাংশ মানুষ বলেন সেই কবেকার তৈরি ‘মীরা’ ছবিটি সাম্প্রতিক কালের গুলজারের ছবির থেকে অনেকবেশী নান্দনিক ও উপভোগ্য।  এখনও ইউটিউবের দৌলতে শুভলক্ষ্মীর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘হে নূতন’ আর 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' গান পাওয়া যায়। এক সময়ে ডি ভি পালুসকর যে অসাধারণ ভজনের প্রবর্তন করেছিলেন, তা শুভলক্ষ্মী হয়ে যশরাজ হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সেই ভজঙ্গুলিতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মারপ্যাঁচের থেকে দরদটাই প্রাধান্য পেত। গায়কীর আকুতিতে দেখনদারি ছিল না। কিন্তু আজ?