মৃত ব্যক্তির কণ্ঠস্বর এবং গল্প সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু চ্যাটবট প্রিয়জনের মতো কথা বলে, এবং কিছু ‘ভয়েস’ অবতার আপনাকে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে ‘কথা বলার’ সুযোগ দেয়।
মৃত্যুর পর মানুষকে হারানো মানে এখন আর একেবারে হারিয়ে যাওয়া নয়—প্রযুক্তি আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে প্রিয়জনের কণ্ঠ, অভ্যাস, এমনকি ব্যক্তিত্বকেও ডিজিটাল আকারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর এই নতুন ব্যবহার দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিশ্বজুড়ে, আর এর মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত কিন্তু শক্তিশালী শিল্প—ডিজিটাল স্মৃতি সংরক্ষণের শিল্প।
সম্প্রতি ‘মেমোরি, মাইন্ড অ্যান্ড মিডিয়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায়, লন্ডনের কিংস কলেজের ড. ইভা নিটো ম্যাকইভয় এবং কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেনি কিড এই প্রবণতার নৈতিক ও মানসিক দিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা খুঁজে দেখেছেন, মানুষ যখন মৃত প্রিয়জনকে স্মরণ করার দায়িত্ব অ্যালগরিদমের হাতে ছেড়ে দেয়, তখন সেই অভিজ্ঞতা কেমন হয়। তাঁদের প্রকল্পের নাম ‘সিনথেটিক পাস্টস’, যার মূল উদ্দেশ্য—প্রযুক্তি কীভাবে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্মৃতির আকার বদলে দিচ্ছে, তা বোঝা।
এই গবেষণায় ব্যবহৃত অন্যতম প্রযুক্তি ছিল ‘ডেথবট’, যা আসলে এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বট। এটি মৃত ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, লেখার ভঙ্গি ও যোগাযোগের ধরণ অনুকরণ করে। পুরোনো ভয়েস রেকর্ডিং, বার্তা, ইমেল এবং সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট বিশ্লেষণ করে এটি এমন এক ভার্চুয়াল অবতার তৈরি করে, যার সঙ্গে কথোপকথন করলে মনে হয় যেন হারানো মানুষটি সামনেই বসে আছে।
তবে, এই প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন আবেগময়, তেমনি অস্বস্তিকরও। অনেক সময় এই ডিজিটাল অবতারগুলির প্রতিক্রিয়া একঘেয়ে ও যান্ত্রিক শোনায়—বাস্তব অনুভূতির গভীরতা সেখানে অনুপস্থিত। তবুও, যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের কাছে এটি এক ধরনের মানসিক আশ্রয়—এক মুহূর্তের জন্য হলেও পুরোনো সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরে পাওয়া যায়।
মিডিয়া বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবণতার শিকড় আসলে মানুষের সেই চিরকালীন ইচ্ছেতে, যেখানে আমরা প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে চাই। আগে যেখানে ছবি বা চিঠি ছিল সেই মাধ্যম, এখন সেখানে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—যা শুধু কণ্ঠ নয়, মানসিক উপস্থিতিকেও পুনর্গঠন করতে পারছে।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই প্রযুক্তি কি আমাদের স্মৃতিকে সত্যিই সংরক্ষণ করছে, নাকি তা কৃত্রিমভাবে নতুন এক “অতীত” তৈরি করছে? প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, মানুষের অনুভূতির জায়গাটা কি কখনও কোনো বট পূরণ করতে পারবে? এই প্রশ্নই আজ নতুন ‘ডিজিটাল পরলোক’-এর মূল বিতর্ক হয়ে উঠছে।
