সংক্ষিপ্ত

  • ভোটের আগে আক্রমণাত্মক শাসক-বিরোধীরা
  • প্রচারে ঝড় তুলতে প্রতিপক্ষকে কটাক্ষ
  • কুড-কথায় বিরোধীদের হেয় করার চেষ্টা
  • এর নেপথ্যে কারনটা বা কি

তপন মল্লিক- এক দশক আগে বাংলার মানুষ রাজ্যপাটে পরিবর্তন দেখেছিল। সেই পরিবর্তন ছিল একটানা ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান। ঠিক দশ বছর পর বাংলার রাজনীতিতে আরেক পরিবর্তন ঘটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে গেরুয়া শিবির। তারা যেন তেনভাবে এ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে উচ্ছেদ করে নিজেদের শাসন কায়েম করতে চায় বাংলায়। এখনও রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘন্ট প্রকাশিত হয় নি। তবে সেই ভোট যুদ্ধের কাল খুব দূরে নয়। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক চাপানউতোর ততই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এ রাজ্যের শাসকদল  তৃণমূল ও প্রধান বিরোধী বিজেপির একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণ এখন রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আরও পড়ুন-রাজ্যের 'খেলসম্মান' অনুষ্ঠান, সম্মানিত হলেন মেহুলি ঘোষ-আতার আলি সহ অন্যরা


আসন্ন বিধানসভা ভোটের বাজারে নতুন আবহ সৃষ্টি করেছে দলবদল। যদিও তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া ক্যাম্প কিংবা বিজেপি ছেড়ে ঘাস ফুলের ছত্র ছাওয়ায় ঠাঁই নেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল অনেক আগে। তবে শাসক দলের ওপর অসন্তোষ থেকে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিতে যাওয়ার নতুন বা প্রবল ঝোঁক বলা যায় তৃণমূলের অত্যন্ত ঘনিষ্ট মুকুল রায়ের পর মমতার সব থেকে বিশ্বাসভাজন শুভেন্দু অধিকারীর দলবদল। তার আগে তৃণমূলে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রথম বিধায়ক হিসেবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন মিহির গোস্বামী। পরবর্তীতে রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তরপাড়ার বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল, বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া-সহ একে একে অনেকেই দলের ভূমিকা নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে তৃণমূল দল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। মনে হচ্ছে ভোট যত এগোবে দলবদলের আরও বহু রঙ্গ-নাট্য ঘটবে এ বঙ্গের রাজনীতিতে, আরও অনেক নাটকীয় মুহূর্তের সাক্ষী হবে এই বাংলা।  

তবে আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে এখনও পর্যন্ত সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা শুভেন্দু অধিকারীর দলবদল। তিনি বিজেপিতে যাওয়ার পর থেকেই তৃণমূল বনাম বিজেপির পারস্পরিক রাজনীতির লড়াই বলা ভাল বাগযুদ্ধ চরম মাত্রা অর্জন করেছে। অতি সম্প্রতি শুভেন্দুর গড় কাঁথিতে জনসভা করে তৃণমূলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সভামঞ্চ থেকে শুভেন্দুকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেন, ‘তোর বাপকে গিয়ে বল আমি পাঁচ কিলোমিটারের মধ‍্যে এখানে আছি, কী করবি করে যা’। যুব নেতা স্বমহিমায় বিরোধী পক্ষকে তোপ দেগেই থাকেন তবে সচরাচর তিনি মেজাজ হারান না। কিন্তু শুভেন্দু প্রসঙ্গে কেবল সুর চড়ান নি, তা ‘তুই-তোকারি’র পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন,  
‘কথায় কথায় তো চ্যালেঞ্জ দিস, হোক চ্যালেঞ্জ জনতার দরবারে দাঁড়িয়ে বলছি। আয় লড়বি? পারবি?’ এদিন যুব নেতা শুভেন্দুর নাম উচ্চারণ না করেই তুই তোকারি করেছেন। অন্যদিকে হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ‘আমি নাম নিয়ে বলছি, ভাব বাচ্যে কথা বলি না। দিলীপ ঘোষ গুন্ডা, অমিত শাহ বহিরাগত, কৈলাস বিজয়বর্গীয় বহিরাগত, ঘুষ খোর শুভেন্দু অধিকারী। ক্ষমতা থাকলে মামলা করে যা’।

আরও পড়ুন-অনুব্রতের গড়ে কেন্দ্রের তোপ, নির্বাচনের আগে বীরভূমে আসছেন নাড্ডা সহ ৪


এতদিন পর্যন্ত শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল যুব নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যতগুলি অভিযোগ তুলেছেন, কার্যত শুভেন্দুর পাড়ায় সভা করে তার প্রত্যেকটির ধরে ধরে জবাব দিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এটাই কি জবাব দেবার ভাষা, নাকি কেউ প্রকাশ্যে বয়সে বড় কাউকে এই ভাষায় সম্বোধন কিংবা কথা বলতে পারেন? শাসক দলের যুব নেতা তথা ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ সরাসরি নাম করে কাঁথিতে শুভেন্দুর বাড়ি ‘শান্তিকুঞ্জ’-র কয়েক কিলোমিটার দূরে তৃণমূলের বিশাল সভা থেকে বলছেন, ‘এমনিতে তো জোকারের মতো মুখ! তার ওপর বড় বড় কথা! আমাকে বলছে যে, এলে দেখে নেব। যদি না শোধরাও, ওই করব, তাই করব। আরে তোর বাপকে গিয়ে বল, তোর বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি! যা করার কর! আয়! হিম্মত আছে? এই মেদিনীপুরের মাটিতে, তোর মাটিতে, তোর পাড়ায়, তোর এলাকায় দাঁড়িয়ে তোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যাচ্ছি’। এরপরও তাঁর শ্লেষ, ‘চার আনার নকুলদানা, তার আবার ক্যাশমেমো। আমাকে থ্রেট দিচ্ছে! আজকে এলাম। আগামী দু’মাসের মধ্যে আরও পঞ্চাশ বার আসব। জামানত বাজেয়াপ্ত করব’। 


ঘটনার পরের দিনই হলদিয়ায় নাম না করে শুভেন্দু অধিকারী অভিষেককে জবাব দেন, ‘যেমন ঝাঁড়, তেমন বাঁশ। এর আগে একজন মেদিনীপুরে এসে প্রধানমন্ত্রীকে তুই তোকারি করে গেছে। আর সেই ঝাড়ের বাঁশ এসে কী কথা বলেছে আপনারা শুনেছেন’ তাঁর কটাক্ষ যে মমতা আর তাঁর ভাইপো অভিষেকের প্রতি এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের খেলা এখন চলবে। ভোট যত এগিয়ে আসবে আক্রমণ আর কুকথার স্রোত তত বাড়বে। কিন্তু কেন এই ভাষায় আক্রমণ কিংবা কুকথার স্রোত। দল কিংবা রাজনীতি কি ভাষা হারিয়েছে, নাকি দিশাহীন? গণতন্ত্রে বিরোধিতা আছে, থাকাটা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু একটি দলের নেতা কিংবা জনপ্রতিনিধি প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে যখন হুঙ্কার দেয় কিংবা বিরোধিদের আক্রমণ করতে কুভাষা ব্যবহার করে, তখন বুঝতে হবে দলটি রাজনীতিশূন্য, আদর্শচ্যুত, স্রেফ গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। অভিষেক বুঝতে পারছেন তাঁদের দলে ভাঙনের স্রোত বইছে, একে একে অনেকেই দল ছাড়ছেন। তাতে নিশ্চয় মনোবলে ঘাটতি পড়ছে। বিরোধিদের চ্যালেঞ্জ নিতে তাঁরা ভয় পাচ্ছেন।পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে থাকলে মেজাজ ঠান্ডা রাখা মুশকিল হয়ে পরে।