সংক্ষিপ্ত
- ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়েছিলেন
- বাংলার জননেত্রী হিসেবে আসীন হয়েছিলেন ক্ষমতায়
- কিন্তু ২০২১ নির্বাচনের কেনও চাপে শাসক দল তৃণমূল
- ১০ বছরের মধ্যে কেন এমন অবস্থার সম্মুখীন হলেন মমতা
শমিকা মাইতিঃ সবে আট দফার মধ্যে দু’দফা ভোট হয়েছে। এরই মধ্যে হাওয়া উঠে গিয়েছে, তৃণমূলকে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত। যদিও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সর্বভারতীয় তৃণমূলের সহ-সভাপতি যশোবন্ত সিনহা শনিবার সাংবাদিক সম্মেললে দাবি করেছেন, পুরোটাই বিজেপির চাল। মিথ্যা প্রচার করে জনতাকে বিভ্রান্ত করে বাকি ছ’দফার ভোটের হাওয়া নিজের দিকে টানতে চাইছে বিজেপি। কে সত্যি, কে মিথ্যা বলছে স্পষ্ট হয়ে যাবে ভোটের ফল বেরোলে। আপাতত একটা বিষয় পরিষ্কার, এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার জমি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু মাত্র দশ বছরে মমতার আসন টলমল হয়ে গেল কেন?গত দশ বছরে বাংলার রাজনৈতিক ছায়াপথ খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ত্রিমুখী পথে ‘আসল পরিবর্তনে’র ডাক এসেছে বাংলায়- তৃণমূলের অপশাসন, বিজেপির আগ্রাসন আর বাংলার মানুষের মোহভঙ্গ।
প্রথমে সাধারণ মানুষের কথায় আসা যাক। ৩৪ বছরে বামশাসনের ভিত ওপড়ানোর ডাক দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের নীতি বা বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে বাম-বিদ্বেষই সেবারের ভোটে মূল চালিকা শক্তি ছিল। ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বামেদের চলা পথ অনুসরণ করেছেন, কখনও বা অতিবাম রাজনীতি করেছেন। এই ভাবে গত দশ বছরে যুযুধান প্রতিপক্ষের স্থান বদল হয়ে গিয়েছে নিঃশব্দে। ক্ষমতাসীন তৃণমূলের প্রতিপক্ষ এখন বিজেপি। ফলে বামবিরোধী যে ভোট এককালে একজোট হয়ে তৃণমূলের ভোটবাক্সে পড়েছিল, আজ আর তা পড়ছে না। বামরাজত্বে অভিযোগ ছিল পার্টি না করলে চাকরি হয় না। তৃণমূলের রাজত্বে সেটাই সামান্য বদলে হয়েছে, টাকা না দিলে চাকরি হয় না। অর্থাৎ যোগ্য লোকের কাজ না পাওয়া নিয়ে আগেও ক্ষোভ ছিল, এখনও আছে। উল্টে তৃণমূল আমলে দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে এমন জট তৈরি হয়েছে যে গত ছ’বছরে এসএসসিতে নিয়োগ বন্ধ। অন্য সরকারি চাকরিতেও নিয়োগ বন্ধ প্রায়। শিল্পায়ন হয়নি বলে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্র সঙ্কুচিত। কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলার যুবসমাজ। শিল্প-সংস্কৃতিতে দৈন্যদশা আরও প্রকট। শিক্ষা-স্বাস্থ্য কোথাও আশার আলো দেখছে না বাঙালি।
তৃণমূলের অপশাসনের কথা আলোচনা করতে গেলে সবার আগে তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট-রাজের কথা বলতে হয়। এক কাঠা জমির উপরে ছোট্ট একটা বাড়ি বানাতে গেলেও তৃণমূলের দাদাদের কথা শুনতে হবে। ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকতে না ঢুকতে চাঁদার আবদার নিয়ে ঘরে চলে আসেন পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা। বার্ধক্য ভাতার টাকা থেকে সরিয়ে রাখতে হয় কাটমানি। এমনকী সরকারি প্রকল্পে শৌচাগার বানানোর টাকা নিয়েও নয়ছয় হয়েছে যথেচ্ছ। কয়লা চুরি, বালি চুরি, গরু চুরি এমকী রেশনের চাল-গমও চুরি হচ্ছে। গত বছর আমফান-দুর্নীতির স্মৃতি ভোলেনি মানুষ। তার উপরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি। একই এলাকায় দু’টো তিনটে করে পার্টি অফিস। একা মমতার পক্ষে রাজ্যের হাজার হাজার তৃণমূল নেতা-কর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বামেদের মতো ক্যাডার ভিত্তিক দল নয় বলে যত সমস্যা তৃণমূলের। পকেটে-পকেটে এক-এক দাদা নিজের মতো করে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। এবার ভোটের আগে সেই দাদাদের অনেকেই আবার শিবির বদলে চলে গিয়েছেন বিজেপিতে। ফলে আরও বেশি করে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। কাজ করছে না তৃণমূলের ভোট মেশিনারি।
এই প্রেক্ষিতে বাংলার মসনদ দখলের লড়াইয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি। এই রাজ্যে গত এক দশকে বিজেপির ভোটশেয়ার বেড়েছে নজর কাড়া হারে। ২০১১ সালে তাদের ভোটশেয়ার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তা বেড়ে হয় ১০ শতাংশ। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি পায় ১৭ শতাংশ ভোট আর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ৪০ শতাংশেরও বেশি। যে হারে ভোট বেড়েছে তাতে ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন খুব একটা অলীক নয় বিজেপির কাছে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, তামিলনাড়ু, কেরল ও পুদুচেরিতে ভোটের দামামা বেজেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার নয়, এই রাজ্যে একাধিক আন্তর্জাতিক সীমারেখা রয়েছে। অনুপ্রবেশের মতো বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে জড়িয়ে রয়েছে এই রাজ্য। তাই বাংলার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে তাঁদের কাছে। এমনিতেই বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটা সময় ছিল যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে বাংলার উচ্চবর্ণ হিন্দু নেতারা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ লাহিড়ির মতো নেতারা ছিলেন এই বাংলাতেই, যাঁরা হিন্দু মহাসভার একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন। তারপরেও বাংলায় হিন্দুত্ববাদ মাথা চাড়া দিতে পারেনি শুধুমাত্র কমিউনিস্টদের জন্য। দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে বামেরা এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের বিভেদ মাথাচাড়া দিতে দেয়নি। সংখ্যালঘু তোষণ করলেও মমতার মতো মাথায় হিজাব টেনে সভা করেননি বাম নেতারা বা ইমামদের ভাতা দেয়নি। সেই ভাবে দেখতে গেলে এই রাজ্যে ফের যে হিন্দুত্ববাদ চাড়া দিয়েছে, তার জন্য বিজেপির যত না কৃতিত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী মমতা নিজে। মমতার তোষণের রাজনীতির জন্য হিন্দু জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে তাকে অস্ত্র করেই এই রাজ্যে শক্তি বৃদ্ধি করেছে বিজেপি। এই ভাবে ত্রিমুখী পথ মিলে একদিকেই অভিঘাত তৈরি করেছে, সেটা হল শাসকদল তৃণমূলের বিরোধিতা। মমতা তার ক্যারিশমা দিয়ে এই আঘাতের কতটা মোকাবিলা করতে পারবেন, বলবে সময়।