সংক্ষিপ্ত
মেরুকরণের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত বিজেপি
অন্যদিকে, ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট পকেটে পুরতে সচেষ্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গ দেখছে সবচেয়ে কড়া মেরুকরণের ভোট
এরই মধ্যে শীতলকুচির ঘটনাকে কেন্দ্র করে তেতে উঠেছে বঙ্গভূমি
শমিকা দাস: মেরুকরণের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত বিজেপি। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের বৈতরণী পেরোতে হিন্দুভোটকে এককাট্টা করার চেষ্টায় রয়েছে তারা। অন্যদিকে, ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের পুরোটা নিজের ঝুলিতে টানতে সদাসচেষ্ট তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরই মধ্যে চতুর্থ দফার ভোটের দিনে শীতলকুচিতে চার মুসলিম ও এক রাজবংশী যুবকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তেতে উঠেছে বঙ্গভূমি। দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের আবহে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ধর্মীয় মেরুকরণ।
১০ এপ্রিল, চতুর্থ দফার ভোটের দিন সকাল থেকে কোচবিহারের শীতলকুচিতে তৃণমূল ও বিজেপির লোকেদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছিল। সেই ঝামেলার মধ্যে পড়ে প্রাণ হারায় আনন্দ বর্মণ নামে ১৮ বছরের এক রাজবংশী যুবক। তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর এলাকায় গণ্ডগোল আরও বাড়লে পরিস্থিতি সামলাতে অতিরিক্ত বাহিনী আসে। ১২৬ নম্বর বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয় হামিদুল, শামিমুল, মইদুল, নূর আলম নামে স্থানীয় চার যুবকের। বাহিনীর দাবি, স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের উপর চড়াও হয়ে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করায় আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে তারা। এই প্রেক্ষিতে বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উস্কানিতেই বাহিনীর উপরে হামলা করার সাহস দেখিয়েছে গ্রামবাসী। তাই পরোক্ষে মমতার উপরেই ঘটনার দায় বর্তায় বলে দাবি তাদের। অন্যদিকে তৃণমূলের অভিযোগ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চার যুবককে গুলি করেছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী। চাইলে কোমরের নীচে গুলি করতে পারত তারা। বুক লক্ষ্য করে গুলির প্রয়োজন ছিল না। এই প্রেক্ষিতে আবার বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর পুরনো একটি বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। জনসভায় সেই ভিডিও-র ক্লিপিং দেখিয়ে যুব তৃণমূলের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘ছয় মাস আগেই বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন সিআরপিএফকে বলেছি বেশি বাড়াবাড়ি করলে বুক লক্ষ করে গুলি করুন। আর শীতলকুচির ঘটনার পরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলছেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। এই দু’টি কথাই ইঙ্গিত দেয় শীতলকুচির ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত।’
প্রসঙ্গত, শীতলকুচির ঘটনার পরদিন, রবিবার দলীয় প্রার্থী পার্নো মিত্রের সমর্থনে বরাহনগরের এক জনসভায় গিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘তৃণমূলের আমলে মা-বোনেরা বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন না। মেয়েরা টিউশনে গেলে চিন্তায় থাকে পরিবার। বাজারে গেলে মা-বোনেদের আঁচল ধরে, হাত ধরে টানা হয়। অভিযোগ করলে দিদি বলেন দুষ্টু ছেলে। এত দুষ্টু ছেলে এল কোথা থেকে। ওই দুষ্টু ছেলেরাই কাল কোচবিহারের শীতলকুচিতে গুলি খেয়েছে। এই দুষ্টু ছেলেরা বাংলায় থাকবে না। সবে শুরু হয়েছে। যারা ভেবেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী বন্দুকটা দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছে, তারা বুঝে গিয়েছে ওই গুলির গরম কেমন। সারা বাংলায় এটা হবে।’ দিলীপ ঘোষকে এই বক্তব্যের জন্য শো-কজ করেছে নির্বাচন কমিশন। বিজেপি নেতা রাহুল ঘোষের ‘চার জন নয়, আট জনের মরা উচিত ছিল’ মন্তব্যের প্রেক্ষিতেও ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন।
এদিকে, কমিশন আরোপিত প্রবেশাধিকারের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর শীতলকুচিতে পৌঁছে গিয়েছেন মমতা। তিনি নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, মমতা মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করেও তোষণের রাজনীতি করছেন। বিজেপি নেতা জে পি নাড্ডা বলেন, ‘আনন্দ বর্মণের মৃত্যুতে কেন নীরব মমতা। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী তৃণমূল। আনন্দকে নিয়ে একটাও কথা বলছেন না মমতা। কারণ আনন্দ রাজবংশী সন্তান ছিলেন। দলিত সমাজের সন্তান।’
আরও পড়ুন - মমতা-র উপর অভিমানী 'মীরজাফর'এর পরিবার, তৃণমূল সমর্থক হয়েও দেবে না ভোট
আরও পড়ুন - ক্রমে 'বাংলার ট্রাম্প' হয়ে উঠছেন মমতা, নির্বাচনে পরাজয় হলে মেনে নেবেন তো
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের ৭১ শতাংশ হিন্দু। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, ২৯৪টা বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৪৫টিতে ৮০ শতাংশের উপর ভোটার হিন্দু। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য যত আসন দরকার, তার চেয়ে মাত্র তিনটে কমে বাকি আসনে হিন্দু ভোটাররা ভাগ্য নির্ধারক। তাই মুসলিম ভোটের মতো হিন্দু ভোটও যাতে এককাট্টা হয় তার চেষ্টা করছে বিজেপি। এই প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হিন্দু তফসিলি জাতি-উপজাতিদের ভোটও। পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার ২৩% তফসিলি উপজাতি। রাজবংশী, মতুয়া আর বাউরিদের সমর্থন বিজেপির দিকে রয়েছে। চা বাগান ও জঙ্গলমহলের দলিতরাও বিজেপির দিকে ঝুঁকে রয়েছে। হিন্দু ভোটশেয়ার বাড়ানোর জন্য রাজবংশী, নমঃশূদ্র ও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভোট টানার চেষ্টা করছে বিজেপি। বিশেষ করে রাজবংশী ভোটের পুরোটাই চাইছে তারা।