সংক্ষিপ্ত

শনিবারই শুরু হল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। একই দিনে বাংলাদেশের ওড়াকান্দি মন্দিরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবঙ্গের মতুয়াদের কাছে পেতেই এই সফর, এমনটাই অভিযোগ। কিন্তু, ওড়াকান্দি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মতুয়া সম্প্রদায়ের জন্য?

শনিবার, একদিকে যখন চলছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটগ্রহণ, সেই একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দেখা গেল বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দিতে মতুয়াদের সর্বোচ্চ তীর্থস্থলে। সেখানকার মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে তিননি জানান, ২০১৫ সালে তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় থেকেই এই স্খানে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। এই প্রথম ভারত বা অন্য যে কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রী এলেন ওড়াকান্দি-তে। তবে অনেকেই বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রীর এই সফর। কিন্তু, ওড়াকান্দি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মতুয়া সম্প্রদায়ের জন্য?

এর উত্তর পেতে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। পূর্বতন বাঙালি সমাজের জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবেই জন্ম হয়েছিল এই সম্প্রদায়ের। অবিভক্ত বাংলায় নমশুদ্র, যারা চন্ডাল  নামেই বেশি পরিচিত ছিল, তাদেরকে হিন্দু সমাজের সনাতন চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে রাখা হতো। এদের বসবাস বেশি ছিল - যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, ঢাকা এবং ময়মনসিংহের জলাভূমি এলাকায়। কারিগরি কাজকর্ম, নৌকোচালনা, কৃষিকাজই ছিল তাদের জীবিকা। বাংলার হিন্দু জনসংখ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েও তারা সামাজিকভাবে বঞ্চিত ছিলেন।

এই সমই ১৮৪৭ সালে ফরিদপুরের এক নমশূদ্র পরিবারে জন্ম হয়েছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল 'মতুয়া' নামে ভক্তিভিত্তিক এক ধর্মদর্শনের। তাদের বক্তব্য ছিল, 'হাতে কাম মুখে নাম' - অর্থাৎ, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করতে করতেই পার্থিব দায়িত্ব পালন করা। এই ঠাকুর পরিবারের নেতৃত্বেই মতুয়া-নমুশূদ্ররা তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন এবং ১৯১৫ সালে ফরিদপুরের ওড়াকান্দিতে 'শ্রী শ্রী হরিচাঁদ মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৩ সালে এই সংগঠনটির নাম বদলে হয়েছিল 'মতুয়া মহাসংঘ। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক সরকারের সমর্থনে তারা একটি পৃথক রাজনৈতিক শ্রেণীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

১৯৪৬ সালে প্রথম মতুয়া আন্দোলনে বিভাজন ঘটে। হরিচাঁদ ঠাকুরের ছেলে গুরুতচাঁদ ঠাকুরের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিলেন, আর তখনকার বিশিষ্ট লম্বা দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সমর্থন করেছিলেন মুসলিম লিগকে। দেশভাগের সময়, নমশূদ্র অধ্যুষিত বেশিরভাগ জেলা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল, ফলে মতুয়া আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

১৯৪৭ সালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ভারতে এসেছিলেন এবং একবছর পরই তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিনাপানি দেবী (বড় মা), উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ঠাকুরনগরে মতুয়া মহাসংঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।ধীরে ধীরে সেখানে হাজার হাজার শরণার্থী, বিশেষ করে হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ এসে বসবাস শুরু করেন। শহরে পরিণত হয় ঠাকুরনগর এবং সেখানেই মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান গড়ে ওঠে। কিনতু, কোনও দিনই তারা কেউ ওড়াকান্দির মতুয়া মহাতীর্থের কথা ভুলতে পারেনি। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল হিন্দু উচ্চবর্ণ অবদমিত সমাজে মতুয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার লড়াই।

এদিন, প্রধানমন্ত্রীর সেই ওড়াকান্দিতে ভ্রমণ, হয়তো সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে সরকম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তবে মতুয়াদের কাছে এ এক আবেগের চোরাটান। এতবছর পর একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাওয়ায়  যেন মতুয়া আন্দোলন মূল স্রোতের স্বীকৃতি পেল। মতুয়া সমাজ অন্তত সেরকমই ভাবছে।