সংক্ষিপ্ত
এই রাজ্যে গত এক দশকে বিজেপির ভোটশেয়ার বেড়েছে নজর কাড়া হারে। ২০১১ সালে তাদের ভোটশেয়ার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তা বেড়ে হয় ১০ শতাংশ। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি পায় ১৭ শতাংশ ভোট আর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ৪০ শতাংশেরও বেশি।
বাংলার মসনদ দখলের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী, দলের সর্বভারতীয় নেতা, এমনকী ভিন্ রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরাও পশ্চিমবঙ্গে এসে বিধানসভা ভোটের ক্যাম্পেনিং করেছেন। নিঃসংশয়ে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভায়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত করেছিলেন ২৫টি সভা। এরমধ্যে শেষদিকে কয়েকটি সভা তিনি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন কোভিড পরিস্থিতির জন্য। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পর্দার পিছনে চাণক্যের ভূমিকাতে বেশি স্বচ্ছন্দ হলেও এবার বাংলার বুকে ৫০টি-রও বেশি জনসভা করেছেন (কর্মিসভা আর রোড-শো ধরা হয়নি)। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা ৬৮টি সভা করছেন। ভিন্ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে যোগী আদিত্যনাথ আর শিবরাজ সিংহ চৌহানকে দিয়ে এই রাজ্যে ভোট ক্যাম্পেনিং করাচ্ছে বিজেপি। যোগী আদিত্যনাথ ৩০টি ও শিবরাজ ১০টি সভা করবেন বলে খবর। এছাড়াও নীতিন গড়করি, স্মৃতি ইরানি, রাজনাথ সিংহের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ভোটপ্রচারে আসছেন বাংলায়। প্রতিবেশী রাজ্য বিহার থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পাণ্ডে, শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ শাহনওয়াজ হুসেন, বিধায়ক নীতিন নবীনদের ভোটপ্রচারে আনা হয়েছে বাংলায়। স্টার ক্যাম্পেনার হিসাবে তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মিঠুন চক্রবর্তী। তিনি নাকি মোট ১০০টা সভা করবেন সব মিলিয়ে। যদিও এখনও পর্যন্ত বাংলায় মাত্র ১৮-১৯টি সভা করেছেন মিঠুন। এছাড়াও ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর, অভিনেতা রবি কিষান, মনোজ তিওয়ারিদের ভোটপ্রচারে আনা হচ্ছে ও হবে। এককথায় এই রাজ্যের ভোটপ্রচারে কোনও কমতি রাখেনি বিজেপি।
আসলে, এই রাজ্যে গত এক দশকে বিজেপির ভোটশেয়ার বেড়েছে নজর কাড়া হারে। ২০১১ সালে তাদের ভোটশেয়ার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তা বেড়ে হয় ১০ শতাংশ। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি পায় ১৭ শতাংশ ভোট আর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ৪০ শতাংশেরও বেশি। যে হারে ভোট বেড়েছে তাতে ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন খুব একটা অলীক নয় বিজেপির কাছে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, তামিলনাড়ু, কেরল ও পুদুচেরিতে ভোটের দামামা বেজেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার নয়, এই রাজ্যে একাধিক আন্তর্জাতিক সীমারেখা রয়েছে। অনুপ্রবেশের মতো বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে জড়িয়ে রয়েছে এই রাজ্য। তাই বাংলার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে তাঁদের কাছে। এমনিতেই বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটা সময় ছিল যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে বাংলার উচ্চবর্ণ হিন্দু নেতারা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ লাহিড়ির মতো নেতারা ছিলেন এই বাংলাতেই, যাঁরা হিন্দু মহাসভার একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন। তারপরেও বাংলায় হিন্দুত্ববাদ মাথা চাড়া দিতে পারেনি শুধুমাত্র কমিউনিস্টদের জন্য। গত এক দশকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোষণের রাজনীতির জন্য হিন্দু জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তাকে হাতিয়ার করে এই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদ জনপ্রিয় করার একটা সুযোগ এসেছে বিজেপির কাছে। এই সুযোগকে সহজে হাতছাড়া করতে রাজি নয় তারা।
এদিকে, এবারের ভোটে বিহারের আরজেডি থেকে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা, এনসিপি - ভিন্রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গীরা তৃণমূলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইঙ্গিত স্পষ্ট, বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে কংগ্রেসের থেকে তৃণমূল অনেক এগিয়ে। আরও পরিষ্কার করে বললে মোদীর বিকল্প হিসাবে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। বাংলায় বিজেপি যেহেতু এখনও মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কাউকে তুলে ধরেনি, সেহেতু লড়াইটা ঘুরেফিরে মোদী বনাম মমতাতেই এসে দাঁড়িয়েছে। তাই এবারের বাংলার লড়াই আদপে ২০২৪-এ লোকসভা ভোটের রিহার্সালে পরিণত হয়েছে। আর এই কারণে ২০২১-এর বাংলার ভোট এ যাবত কালের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীর কাছে।
বাংলা জয়ের লক্ষ্যে বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের অনেক আগে থেকেই এই রাজ্যে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় নেতারা। বাংলাকে ৫টি জোনে ভাগ করে নিজের আস্থাভাজন ভিন্রাজ্যের পাঁচ নেতা সুনীল দেওধর (হুগলি-হাওড়া-মেদিনীপুর), দুষ্যন্ত গৌতম (কলকাতা), বিনোদ তাওড়ে (নবদ্বীপ), বিনোদ সোনকর (রাঢ়বঙ্গ) এবং হরিশ দ্বিবেদীকে (উত্তরবঙ্গ) পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছেন অমিত শাহ। লোকসভা কেন্দ্র ধরে সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। আগে একএকটা মণ্ডল কমিটি যেখানে ২১০-২৭০টা বুথের দেখভাল করত, সেটা কমিয়ে ৬০-৯০ করা হয়েছে। যাতে আরও ভাল ভাবে বুথগুলোর কাজ পর্যালোচনা করা যায়। ৫-৭টা বুথকমিটি নিয়ে গঠন করা হয়েছে শক্তিকেন্দ্র। এগুলোর দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বলে বিস্তারক। এই পদে মূলত আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকরা কাজ করেন। এই ভাবে বিজেপির সাংগঠনিক ভিত হিসাবে তলে-তলে কাজ করে চলেছে আরএসএস। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরও মেনে নিয়েছেন, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপির সাংগঠনিক শক্তির কথা। তাঁর মতে, বামদল থেকে যাঁরা বিজেপিতে এসেছেন, তাঁরাও সংগঠনের হয়ে কাজ করছেন। বাংলার এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে বিজেপির লোকবল নেই।
এই ভাবে বুথ স্তরে সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে ও হাইভোল্টেজ প্রচার করে এই রাজ্যে ‘আসল পরিবর্তন’ আনার চেষ্টা করছে বিজেপি। মোদীর কথায় ‘বাংলার আসল পরিবর্তন আনাই হবে বিজেপি-র কাজের আধার। এমন বাংলা হবে যেখানে যুবকদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এমন বাংলা যেখানে মানুষকে রাজ্য ছেড়ে যেতে হবে না। আসল পরিবর্তন মানে এমন বাংলা, যেখানে শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি হবে। বিনিয়োগ আসবে। এমন বাংলা যেখানে একুশ শতকের আধুনিক পরিকাঠামো হবে। যেখানে গরিবদের অগ্রসর হওয়ার সুযোগ থাকবে।’