সংক্ষিপ্ত
- হুগলির বাঁশবেড়িয়ার বাসিন্দা শুভেন্দু দত্ত
- পেশায় হাইস্কুলের শিক্ষক
- গরিবদের জন্য সংগ্রহ করেন পুরনো পোশাক
- চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে তাঁর দোকান
ঝা চকচকে শোরুমের সঙ্গে তুলনা হয় না। টিনের চাল ঘেরা ভাঙাচোড়া দোকানে সাজিয়ে রাখা পোশাকগুলিও কিছুটা মলিন। যে আসছেন পছন্দমতো পোশাক নিয়ে চলে যাচ্ছেন। না,পোশাক নিতে কোনও দাম লাগে না। দোকানও চব্বিশ ঘণ্টা খোলা। শর্ত একটাই, একা সব পোশাক নেওয়া চলবে না। সুযোগ দিতে হবে অন্যকেও।
হুগলির বাঁশবেড়িয়ার শুভেন্দু মাস্টারের দোকান এমনই। হ্যাঁ, এই দোকান থেকে পোশাক নিতে গেলে কোনও দাম দিতে হয়না। আসলে এই দোকানটাই তাঁদের জন্য, যাঁরা দাম দিয়ে পোশাক কিনতে পারেন না। পুজোয় যখন নতুন পোশাকে সেজে ওঠেন সবাই, তখনও হয়তো এই মানুষগুলোকে ছেঁড়া, ফাঁটা, পোশাকেই ঘুরতে হয়। তাই নতুন পোশাক না হোক, সবার হাতে অন্তত পুরনো কিন্তু ভাল জামাকাপড় তুলে দিতেই এই দোকান খুলেছেন ত্রিবেণীর একটি স্কুলের শিক্ষক শুভেন্দু দত্ত। মাস্টারমশাইয়ের এ হেন উদ্যোগের কথা জানতে পেরেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর ছাত্ররাও।
বাঁশবেড়িয়ারই বাসিন্দা শুভেন্দুবাবুর কথায়, 'আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই অনেক পুরোনো জামাকাপড় আলমারিতে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। অথবা পোকায় কাটছে। কিন্তু আবার অনেকের কাছে সেই পুরোনো বস্ত্রই লজ্জা নিবারণের উপায় হয়ে যায়। ঠিক এই ভাবনাটাই আমায় নাড়িয়ে দিয়েছিল।'
নিজের একান্নবর্তী পরিবার হওয়ায় প্রথমে বাড়ি থেকেই বেশ কিছু পুরনো পোশাক পেয়ে যান শুভেন্দুবাবু। বছর দু'য়েক আগে এভাবেই শুরু হয় তাঁর যাত্রা। পুরনো সেই সব পোশাক বেশ কিছু মানুষের হাতে তুলেও দেন তিনি। এভাবেই চলতে চলতে একদিন স্কুলের ছাত্ররা মাস্টারমশাইয়ের এ হেন উদ্যোগের কথা জানতে পেরে তারাও স্যরের সঙ্গে হাত মেলায়। তৈরি হয় একটি টিম। শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার। বাঁশবেড়িয়া ছেড়ে সুদূর কল্যাণী, কাঁচরাপাড়া, মগরা, ব্যান্ডেল, চুঁচুড়া এমন কী কালনা থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বহু মানুষ। অনেকেই পোশাক দান করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। সংগ্রহ করা হয় প্রচুর পুরনো জামাকাপড়।
কিন্তু পোশাক সংগ্রহ করলেই তো হল না, যাঁদের তা প্রয়োজন তাঁদের কাছে সেগুলি পৌঁছে দিতে হবে। তাই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাঁশবেড়িয়ার বিখ্যাত হংসেশ্বরী মন্দিরের পাশেই একচিলতে দোকান ঘর খোলা হয়। চিত্তরঞ্জন বর নামে স্থানীয় এক চা বিক্রেতাই ওই জায়গাটি ছেড়ে দেন শুভেন্দুবাবুকে। সেই দোকানেই এখন সাজানো থাকে শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি থেকে শুরু করে ছোটবড় নানা মাপের পোশাক। ইচ্ছে মতো সেখান থেকে পোশাক নিয়ে যান অনেকেই। আর পাঁচটা দোকানের মতো পুজোর আগে এই দোকানেও ভিড় বেড়েছে। ফারাক শুধু একটাই, দামের বালাই নেই। অনেকেই যেমন পোশাক নিতে ভিড় করছেন, সেরকমই বাড়ির পুরনো পোশাক দিয়েও যাচ্ছেন প্রচুর মানুষ। চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকলেও এখনও দোকান থেকে কিছু চুরি যায়নি।
দোকানের গায়ে অবশ্য ছোট ছোট পোস্টারে বেশ কিছু নির্দেশিকা দিয়ে রেখেছেন শুভেন্দুবাবু। সেখানে লেখা রয়েছে, 'বিনা পয়সার দোকান, যার প্রয়োজন নিয়ে যান'। আবার কোথাও লেখা, 'সব একা নেবেন না , সবাইকে নিতে দিন।' এই দোকান থেকে পোশাক নিয়ে কেউ যাতে বিক্রি না করেন, সেই অনুরোধও করা হয়েছে।
রবিবারও মগরা স্টেশন লাগোয়া রেল বস্তিতে গিয়ে তিন হাজার পোশাক বিতরণ করে আসেন শুভেন্দুবাবু। এ কাজে তাঁকে যাঁরা সাহায্য করছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম চা বিক্রেতা চিত্তরঞ্জন বর জানান, 'আমরা প্রায়ই বিভিন্ন বস্তিতে গিয়ে গরিব, দুঃস্থদের এই সব পোশাক দিয়ে আসি। শুধু পোশাক নয়, এখন অনেকে পুরোনো জুতাও আমাদের দিয়ে যান, প্রচুর কম্বল, শীত পোশাক আমরা এবার পেয়েছি। শীত কালে সেগুলি দেওয়া হবে।'
পোশাক হয়তো পুরনো। কিন্তু শুভেন্দু স্যরের দোকানে যাঁরা পোশাক নিতে আসছেন, তাঁদের কাছে সেগুলিই নতুনের সমান। পোশাক পেয়ে তাঁদের মুখের হাসিটুকুই প্রাপ্তি শুভেন্দুবাবু এবং তাঁর সহকারীদের।