সংক্ষিপ্ত
- জেলাশাসক পদে রদবদল নিয়ে জোর বিতর্ক
- ফের বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এল পুরুলিয়া
- জেলাশাসক রাহুল মজুমদারকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে গুঞ্জন
- 'দাবাং' জেলাশাসক হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন রাহুল
বুদ্ধেদব পাত্র, পুরুলিয়াঃ- বদলে দেওয়া হল পুরুলিয়ার 'দাবাং' জেলাশাসক রাহুল মজুমদারকে। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নিচ্ছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। ডবলুবিসিসিএস এক্সিকিউটিভ ক্যাটিগরির অফিসার অভিজিৎ। ছিলেন কলকাতার পোদ্দার কোর্টে রাজ্য সরকারের পর্যটন বিভাগে। সেখান থেকে তিনি এবার পদোন্নতি পেয়ে চলে যাচ্ছেন পুরুলিয়াতে। পুরুলিয়াবাসী-র কাছে জেলাশাসক পদে এই রদবদল একদমই অস্বাভাবিক। ফলে, মঙ্গলবার সকালে জেলাশাসক রাহুল মজুমদারের বদলি-র খবর চাউড় হতে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে।
লকডাউন-কে সফল করতে রাস্তায় নেমে নেতৃত্ব
এখন পর্যন্ত যা খবর, প্রশাসনিকস্তরে যথেষ্ট দক্ষ অফিসার বলে পরিচিত রাহুল। কলকাতা লাগোয়া শহরতলির ছেলে তিনি। দেড় বছর হল পুরুলিয়ায় জেলাশাসক হিসাবে শাসনভার সামালিচ্ছিলেন। ঘরে-ঘরে পৌঁছে গিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খবর নিয়েছেন। বিশেষ করে লকডাউন পর্বে তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনেছেন। এমনকী তাদের কাছে নিজের হাতে ত্রাণ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। রাস্তায় নেমে লকডাউন সফল করতে টহল দিয়েছেন। যারা লকডাউনের নিয়ম ভেঙেছেন তাদের ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে শাস্তিও দিয়েছেন। যেমন কান ধরে ওঠ-বস করানো থেকে মাস্ক উপহার দেওয়া বা রাস্তার মাঝে দাঁড় করিয়ে কোভিড সচেতনতার বার্তা দেওয়া। জুলাই পর্যন্ত পুরুলিয়া ছিল করোনাভাইরাস ফ্রি জেলা। এরপর পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার স্রোত বাড়তে থাকায় এই তকমা আর ধরে রাখতে পারেনি পুরুলিয়া।
মাস্ক না পরায় থাপ্পড় বিতর্ক, 'দাবাং' তকমা
এতে অবশ্য থমকে যানিন রাহুল মজুমদার। তিনি রাস্তায় নেমে এবার মাস্ক পরানোর অভিযান শুরু করেছিলেন। এমনকী রাস্তার ধারে থাকা সমস্ত দোকানে হানা দিয়ে সকলকে মাস্ক পরতে বাধ্য করিয়েছিলেন। তাঁর এই স্ববাবের জন্য অনেকে 'দাবাং' তকমাও দেন। যদিও, রাহুল মজুমদার বিতর্কে জ়ডান এক সরকারি কর্মীকে থাপ্পড় মেরে। এই মাস্ক পরানো অভিযানের সময় পুরুলিয়া শহরে এক যুবককে মাস্ক না পরা অবস্থায় ধরেছিলেন পুরুলিয়ার তৎকালিন জেলাশাসক রাহুল মজুমদার। ওই যুবক জানান তিনি মেদিনীপুর থেকে জরুরি কাজে পুরুলিয়ায় এসেছেন এবং তিনি একজন সরকারি কর্মচারি। তার কাছে মাস্ক রয়েছে। তবে তা পকেটে। অভিযোগ, রাহুল মজুমদার কোনও কথা না শুনেই ওই যুবককে থাপ্পড় মেরে দেন। এতে সরকারি কর্মচারি মহলে রাহুল মজুমদারের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, পুরুলিয়ার সাধারণ মানুষ সর্বোতভাবে জেলাশাসকের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিল এবং তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। যার জেরে বিতর্ক বেশিদূর গড়ায়নি।
আরও পড়ুন, আজ নবান্নে মমতা- বিনয় তামাংদের বৈঠক, জট কাটিয়ে হবে কি জোট
অনাহারে মৃত্যুর গুজবের বিরুদ্ধে গিয়ে আসল সত্যকে প্রকাশের দাবি
পুরুলিয়ার রাজবাঁধে একটি রিক্সাওয়ালা পরিবারের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। বেশকিছু সংবাদমাধ্যম লকডাউনে অনাহারে মৃত্যু বলে সেই খবর প্রচার করে দেয়। এই নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। শেষমেশ আসরে নেমেছিলেন জেলাশাসক রাহুল মজুমদার। তিনি পুরো বিষয়টি প্রাথমিক তদন্ত করে জানান, কিশোরটি বহু বছর ধরে ব্রেন টিউমারে ভুগছিল। শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না।
বৃষ্টিতে ভিজে দলিতদের রেশনকার্ড উদ্ধার
লকডাউন শুরু হতেই পুরুলিয়ার বলরামপুরে একটি গ্রামে বহু পরিযায়ী শ্রমিক একসঙ্গে ফিরে আসেন। কিন্তু, আইসোলেশনের জায়গা না পেয়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকরা গাছের উপরে বসবাস করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে জেলাশাসক ওই পরিযায়ী শ্রমিক যুবকদের গাছ থেকে নামিয়ে আনেন এবং স্থানীয় একটি আইটিটিসি সেন্টারে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করান স্থানীয় ব্লক লেভেল আধিকারিককে দিয়ে। বলরামপুরে দলিতদের কাছে থেকে রেশন কার্ড বন্ধক নেওয়া কারবারের রমরমা। এর জেরে লকডাউনে ওই দলিত পরিবারগুলি সরকারি রেশন পাচ্ছিল না। এশিয়ানেট নিউজ বাংলা সেই খবর প্রকাশ করতেই উদ্যোগী হয়েছিলেন জেলাশাসক রাহুল মজুমদার। তাঁর নির্দেশে বিডিও রাতের অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে বন্ধকী রেশনকার্ড উদ্ধারে অভিযান করেন এবং দলিতদের ওই রেশন কার্ড ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন, 'রাজ্য সরকারের আসল রূপ সামনে আনব', বিমানবন্দরে নেমেই বিস্ফোরক কৈলাশ বিজয় বর্গীয়
পুরুলিয়া জেলাকে হাতের তালুর মতো চেনেন
এহেন রাহুল মজুমদারের চলে যাওয়া নিয়ে স্বাভাবিকবাবেই দুঃখ পুরুলিয়াবাসী। দেড় বছর আগে পুরুলিয়ার জেলাশাসকের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে পরেই পুরুলিয়ার জেলা শাসক পদে যোগ দিয়েছিলেন রাহুল মজুমদার। এর আগে তিনি ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ পুরুলিয়া জেলা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নের দায়িত্ব সামলিয়েছিলেন তিনি। সেই সুবাদে পুরুলিয়া জেলাকে হাতের তালুর মতো চিনতেন। জেলাশাসকের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিন থেকেই রাস্তায় নেমে কাজ করে গেছেন। ছুটির দিনেও জেলার বিভিন্ন ব্লকে গিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ খতিয়ে দেখেছেন। রেশন থেকে আই সি ডি এস, ১০০দিনের কাজ আবার করোনা আবহ শুরু হতেই পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যার সমাধান করেছেন। মে মাসে শুরু হওয়া মাটির সৃষ্টি প্রকল্প দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করিয়ে মাঠের উৎপাদিত ফসল মার্কেটে পৌঁছে দিয়ে কৃষকদের রোজগারের পথকে মসৃণ করে নজির তৈরি করেছেন।
আরও পড়ুন, 'আগুন নিয়ে খেলবেন না', জেলাশাসক-পুলিশ সুপারকে হুঁশিয়ারি রাজ্যপালের
রাহুল মজুমদারের বদলি-তে তুঙ্গে তরজার রাজনীতি
তবুও তার বদলিতে প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি পুরুলিয়া জেলা বিজেপি। জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বিবেক রাঙ্গা জানিয়েছেন, 'এখন তো ভোট আসছে যেখানে যেখানে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি রয়েছে সেখানে সরকার চাইছে নিজের পেটোয়া লোক গুলোক বসাতে। এই ডি এম হয়তো দলের কথা শোনেননি তাই বদলি করা হল। তবে উনি যে কয় দিন পুরুলিয়ায় ছিলেন ভালো কাজ করেছেন এটা স্বীকার করতেই হয়।' জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র নবেন্দু মাহালি বিজেপির এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, 'এটা রাজ্য সরকারের রুটিং বদলি। প্রশাসনিক স্তরে এই বদলি হয়েই থাকে। রাহুলবাবু পুরুলিয়ায় যোগ দিয়ে প্রথম দিন থেকেই ভালো কাজ করে গেছেন। আশা করি যিনি আসছেন তিনিও পুরুলিয়ার জন্য ভালো কাজ করবেন।'
রাহুল মজুমদারের সিএমও অন্তর্ভুক্তি কি কোনও কৌশল সরকারের
তবে জেলার রাজনৈতিক মহলে এখন একটাই প্রশ্ন পূর্বতন জেলা শাসক জেলাশাসক যে ভাবে মানুষের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনে সুরাহা করতেন সেটা হবে তো। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ যে ভাবে নিজে দের বাড়ির কাছে পেয়ে সমস্যার কথা তুলে ধরতেন সেই সুযোগ নতুন জেলা শাসকের কাছে থাকবে তো? অন্যদিকে, সূত্রের খবর বেশকিছুদিন ধরেই কলকাতার আশপাশে কোনও জেলায় বদলি চাইছিলেন রাহুল মজুমদার। দক্ষ এই প্রশাসককে আপাতত খোদ নবান্নে টেনে নিয়ে যাওয়ার পিছনে ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কোনও কৌশল কাজ করছে কি না তা সময়ই বলবে।