সংক্ষিপ্ত

কেন্দ্র হোক বা রাজ্য- এক নতুন শব্দের আমদানি হয়েছে, নাম পিপিপি। আর এই পিপিপি মডেলে-ই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক বৃদ্ধাবাস রাতারাতি বনে গিয়েছে হোটেল ও রেস্তোরাঁ। 
 

সম্প্রতি সমাজ ও আইন গবেষক ও আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করেন। এই পোস্টে তিনি দাবি করেন, বোলপুরে 'আমাদের শান্তিনিকেতন' বলে যে হোটেল এবং রেস্তোরাঁ রয়েছে, তা আসলে একটি সরকারি বৃদ্ধাবাস। ২০১৯ সালে এই বৃদ্ধাবাসের রক্ষণাবেক্ষণ-এর দায়িত্ব নাকি পেয়েছিল স্বাধীন ট্রাস্ট। বোলপুরের গোয়ালপাড়ায় 'আমাদের শান্তিনিকেতন' বলে এই বৃদ্ধাবাস। কিন্তু সেখানে এখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা কম, তুলনায় বহিরাগত অতিথিদের জন্য থাকার ঘরের সংখ্যা বেশি। রয়েছে রেস্তোরাঁ। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। একের পর এক অনুসন্ধানে সামনে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দেখা যায় সত্যি সত্যি একটি বৃদ্ধাবাসকে কীভাবে বদলে ফেলা হয়েছে একটি হোটেল কাম রেস্তোরাঁয়। আর অনেকটা কুমিরর ছানা দেখানোর মতো কিছু বৃদ্ধাকে সেখানেই বিল্ডিং-এর অংশে স্থান করে দেওয়া হয়েছে। সত্যানুসন্ধানের এই অভিযানে সামনে আসে একের পর এক মিথ্যা কথা এবং একটা দুর্নীতি চক্রের অনৈতিক মুনাফা কামানোর ধান্ধাবাজি। এশিয়ানেট নিউজ বাংলার প্রশ্নের সামনে হয় এক এক করে সব ডাহা মিথ্যা কথা বলে গিয়েছেন, না হলে ঢোক গিলতে গিলতে হ্যালো-কিছু শুনতে পারছি না বলে ফোন রেখে দিতে বাধ্য হয়েছেন।  

২০১৯-এ বোলপুরের গোয়ালপাড়া মৌজার প্লট নম্বর ৬৮৯, জিএল নম্বর ৬৫, যার থানা শান্তিনিকেতন-এর ঠিকানায় একটি বৃদ্ধাবাসের রক্ষণাবেক্ষণ, মার্কেটিং, আপগ্রেডেশন এবং অপারেশন-এর জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল শ্রীনিকেতন শান্তিনিকেতন ডেভলপমেন্ট অথরিটি। এই দরপত্রের পর-ই স্বাধীন ট্রাস্ট 'আমাদের শান্তিনিকেতন' বলে ওই বৃদ্ধাবাসের দায়িত্ব প্রায়। কিন্তু, কয়েক বছরের মধ্যেই সেখান থেকে বৃদ্ধাদের বিল্ডিং-এর একটা অংশে সরিয়ে দিয়ে তৈরি করে ফেলা হয় হোটেল এবং রেস্তোরাঁ। যেখানে নির্দিষ্ট মূল্যের কোনও ঘর পাওয়া যায় না। রয়েছে এসি, নন-এসি রুম। যার মূল্য ধার্য হয় চাহিদার উপরে।  

সত্যি সত্যি কি বৃদ্ধাবাসের আড়ালে গজিয়ে উঠেছে হোটেল এবং রেস্তোরাঁ? বিষয়টি খোঁজ নিতে নামে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। 'আমাদের শান্তিনিকেতন' বলে একটি ভিজিটিং কার্ড অন্তর্তদন্তে হাতে আসে। সেই ভিজিটিং কার্ডের উপরে একটি ফোন নম্বর লেখা ছিল, তা হল ৭৪৭৯০০২৮০৬। এই নম্বরে ফোন করতেই ফোন ধরা ব্যক্তি জানান নম্বরটি বর্তমানে শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজের কর্মীদের জন্য দেওয়া হয়েছে। যেহেতু স্বাধীন ট্রাস্ট-ই 'আমাদের শান্তিনিকেতন' পরিচালনা করে, সেই কারণে আগে এই নম্বরটি সেখানে ছিল। এখান থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় যে স্বাধীন ট্রাস্টের সঙ্গে 'আমাদের শান্তিনিকেতন'-এর যোগ যে শুধু কথার কথা নয়। ফোন ধরা ব্যক্তিটি 'আমাদের শান্তিনিকেতন'-এর যোগাযোগের আরও একটি নম্বর দেবেন বলে ফোন কেটে দিয়েছিলেন। পরে আমাদের শান্তিনিকেতনের ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকা অন্য একটি নম্বরে ফোন করা হয় এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে। 

এই ফোনে এক মহিলা জানান, পুজোর সময় ঘর পাওয়া যাবে, তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য অন্য এক ব্যক্তি দিতে পারবেন। এর মাঝে দুবার লাইন কেটেও যায়। পরে ওই ফোনে ফের ফোন করে জানা যায় যে, আমাদের শান্তিনিকেতনে থাকার রুম এবং খাওয়া-দাওয়া পাওয়া যাবে। পুজোর সময় এলে ৫টি রুম নিলে ঘর পিছু ২৫০০ টাকা করে পড়বে বলেও জানান ওই ব্যক্তি। সেই সঙ্গে জানান খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনও অসুবিধাতেই পড়তে হবে না। কারণ হোটেলের সঙ্গেই রয়েছে একটা বৃদ্ধাবাস। তিনি নিজেও জানান যে আগে এটা পুরোটাই বৃদ্ধাবাস ছিল, এখন মলয় পিট দায়িত্ব নেওয়ার পর সেখানে বৃদ্ধাবাসের সঙ্গে হোটেলও খোলা হয়েছে। সারা বছরই সেখানে অতিথি-দের ভিড় লেগে থাকে। 

একটা সরকারি বৃদ্ধাবাসকে কীভাবে রাতারাতি হোটেল করে দেওয়া যেতে পারে, এই নিয়ে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা পৌঁছে যায় শ্রীনিকেতন শান্তিনিকেতন ডেভলপমেন্ট অথরিটি-র বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিকের কাছে। ফোনের কথোপকথনে আধিকারিক তন্ময় বন্দ্যোপাধ্য়ায় জানান, তিনি মাত্র ১৫ দিন জয়েন করেছেন। এই বিষয়ে তাঁর কাছে বিস্তারিত কোনও তথ্য নেই। তবে, কোনও সরকারি বৃদ্ধাবাসকে হোটেলে এমনি এমনি পরিবর্তন করা যায় না বলে জানান তিনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলেন এসএসডিএ-এর আধিকারিক। এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে এরপর ফোনে ধরা হয় এসএসডিএ-এর এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সাত্যকি সাহা-কে। তিনি প্রথমে ফোন তুলে ভালো করে কথা বলতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু এশিয়ানেট নিউজ বাংলার প্রশ্ন শুনেই তাঁর ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। কিছুক্ষণ ফোন ধরে আমতা আমতা করার পর, হ্যালো-হ্যালো বলে ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার সাত্যকি সাহা-কে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। 

পিপিপি মডেলের নামে এমন এক অসাধু ব্যবসার মাধ্যমে একটা সরকারি বৃদ্ধাবাস যে হারিয়ে যেতে বসেছে, তা অন্ততর্দন্তে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। এই অন্তর্তদন্তে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল আমাদের শান্তিনিকেতন নামে একটি ওয়েবসাইট। যে ওয়েবসাইটে বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছিল হোটেল ও রেস্তোরাঁ-র নামে। ওয়েবসাইটের কোনও অংশে ছিল না বৃদ্ধাবাসের নূন্যতম ঠিকানা। যদিও, এশিয়ানেট নিউজ বাংলার অন্তর্তদন্তের পর ওই ওয়েবসাইটকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। এখন এই ওয়েবসাইট খুললে শুধুমাত্র কালো ব্যাকড্রপে আন্ডার মেনটেন্যান্স লেখা ভেসে উঠছে। সন্দেহ নেই হয় ওয়েবসাইটটিকে এভাবেই অকেজো করে ফেলে রাখা হবে, অথবা ওয়েবসাইট থেকে .হোটেল এবং রেস্তোরাঁর সমস্ত তথ্য মুছে ফেলার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু, যথারিথি এশিয়ানেট নিউজ বাংলার কাছে থাকা বিভিন্ন প্রমাণ ও নথি-কে কীভাবে নষ্ট করবে এই অসাধু ব্যবসায়ী চক্র!  

এশিয়ানেট নিউজ বাংলার অন্তর্তদন্তে আরও এক বড় হাতিয়ার ছিল গুগল ম্যাপ। সেখানেও বৃদ্ধাবাস আমাদের শান্তিনিকেতন এবং গেস্ট হাউস কাম রেস্তোরাঁর ঠিকানাও ভেসে ওঠে। আসলে গোয়ালপাড়ার ওই একই ঠিকানায় আমাদের শান্তিনিকেতন নামে বৃদ্ধাবাস-এর নাম দিয়ে গুগল ম্যাপে জিপিএস লোকেশন তৈরি করা হয়েছিল। আবার একই সঙ্গে আমাদের শান্তিনিকেতন নামে হোটেল ও রেস্তোরাঁর ঠিকানা দিয়েও গুগল ম্যাপে জিপিএস লোকেশন তৈরি করা হয়েছিল। যার প্রমাণ আমাদের পাঠকরা নিচের ছবিতেই দেখতে পাবেন। 

সরকারি বৃদ্ধাবাস-কে কীভাবে হোটেল বা রেস্তোরাঁ বানানো হল, সেই প্রশ্ন নিয়ে স্বাধীন ট্রাস্টের মাথা বলে পরিচিত মলয় পিট-এর কাছেও পৌঁছে যায় এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। সরকারি বৃদ্ধাবাসকে হোটেল ও রেস্তোরাঁ বানানোর কথা এক্কেবারে উড়িয়ে দেন তিনি। অথচ, তারই সংস্থার অন্য কর্মীরা জানিয়েছেন যে সরকারি বৃদ্ধাবাসের মধ্যে আমাদের শান্তিনিকেতন নামে একটি হোটেল ও রেস্তোরাঁ চলছে।  সরকারি বৃদ্ধাবাসকে বেআইনিভাবে হোটেল ও রেস্তোরাঁ বানানোর বিষয়টি যে কত বড় অপরাধ তা মলয় পিটের মতো ব্যবসায়ী বোঝেন না এমনটা হতে পারে না। 

এই একই বিষয় নিয়ে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে কথা বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায়ের। তিনি জানান, এসএসডি-এর অধীনে কোনও সরকারি বৃদ্ধাবাসকে যে হোটেল ও রেস্তোরাঁ বানানো হয়েছে সে বিষয়ে তাঁর কাছে কোনও .তথ্য নেই। তবে, এই বিষয়ে অভিযোগ এলে তিনি খতিয়ে দেখবেন।  

প্রশ্ন হচ্ছে, এসএসডিএ যে দরপত্র আহ্বান করেছিল তাতে কোনওভাবেই হোটেল ও রেস্তোরাঁর উল্লেখ ছিল না, সেখানে পরিস্কারভাবে লেখা ছিল যে একটি বৃদ্ধাবাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার মানোন্নয়নের জন্য এক্সপ্রেসন অফ ইন্টারেস্ট বা ইওআই চাওয়া হচ্ছে। তাহলে স্বাধীন ট্রাস্টের আড়ালে মলয় পিট একটি সরকারি বৃদ্ধাবাসকে বদলে ফেলে হোটেল ও রেস্তোরাঁ বানানোর মতো সাহস দেখালেন কোথা থেকে? বোলপুরের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে সরকারি সম্পত্তিকে ঘিরে পিপিপি মডেলের নামে এতবড় একটা জালিয়াতি বছরের পর বছর চলল আর তা প্রশাসনের গোচরে এল না! বীরভূম প্রশাসনের এমন দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য! মলয় পিটের তৈরি করা ট্রাস্টের গাড়ি অনুব্রত মণ্ডল দিনের পর দিন ব্যবহার করেছেন। মলয় পিট নিজেও অনুব্রত মণ্ডলের পর সেকথা স্বীকার করেছেন। তাহলে, কি মলয় পিটের এই অনৈতিক উদ্দেশে অনুব্রত-রও হাত ছিল? আর সেই কারণেই প্রশাসনও দিনের পর দিন পুরো বিষয়টিকে দেখেও না দেখার ভান করে গিয়েছে! এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার মুহূর্তে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার হাতে আরও কিছু তথ্য এসে পৌঁছেছে, আমাদের শান্তিনিকেতন বলে গেস্ট হাউস ও রেস্তোরাঁর ওয়েবসাইটকে অকেজো করাই শুধু নয়, আমাদের শান্তিনেকতেন হোটেলে থাকা বোর্ডারদেরও রাতারাতি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর অনেকটাই ভাড়া করে বৃদ্ধা আনার মতো সেখানে নাকি আনা হচ্ছে বৃদ্ধাবাসের নতুন সদস্যদের। আম জনতার রক্ত জল করা অর্থে সরকারি উদ্যোগে তৈরি হওয়া বৃদ্ধাবাসে স্বাধীন ট্রাস্ট যে অসাধু ব্যবসা ফেঁদে বসেছে তাতে আর কি পর্দা ফেলা যাবে! সেটা এই ঘটনার আরও অন্তর্তদন্ত বলে দেবে।     
আরও পড়ুন- 
অনুব্রত পেয়াদা, মলয় যদি মুখোশ হয় তাহলে পিছনে কারা, চাঞ্চল্যকর দাবি বিশ্বনাথ গোস্বামীর 
অনুব্রত মন্ডলের আরও সম্পত্তির হদিস মিলল! হিসেবরক্ষকের থেকে তথ্য সংগ্রহ সিবিআইয়ের 
‘‘নাচব? নাচব নাকি ডেকেছে বলে?’’ অভিষেককে ইডির তলব নিয়ে প্রশ্নে মেজাজ হারালেন কেষ্ট