কলকাতায় শুরু হয়েছে ৫৪তম আইটিসি সঙ্গীত সম্মেলন ২০২৫, যেখানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী পরভীন সুলতানাকে 'আইটিসি সঙ্গীত সম্মান ২০২৫' প্রদান করা হয়েছে। তিন দিনের এই উৎসবে বিশিষ্ট শিল্পীরাও অংশ নিচ্ছেন। 

আইটিসি সঙ্গীত সম্মেলন ২০২৫ মহা আড়ম্বরে শুরু;

দিগ্‌গজ পরভীন সুলতানাকে প্রদান করা হল আইটিসি সঙ্গীত সম্মান

কলকাতা, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫: ৫ থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (আইটিসি এসআরএ)-এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত ৫৪তম আইটিসি সঙ্গীত সম্মেলন ২০২৫ এ বছর ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে, যেখানে দেশ-জুড়ে সঙ্গীতবিশারদ, রসিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অ্যাকাডেমির মনোরম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত তিন দিনের এই উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গভীরতা, বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধ ধারা প্রতিফলিত হয়েছে- যা আইটিসি এসআরএ প্রায় পাঁচ দশক ধরে সযত্নে লালন করে আসছে। সম্মেলনে অংশ নেন বহু কিংবদন্তি শিল্পী, বিশিষ্ট গুরু, অভিজ্ঞ সহযোগী শিল্পী এবং অ্যাকাডেমির প্রতিভাবান স্কলাররা—যারা মিলিতভাবে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ঐতিহ্য, দক্ষতা এবং নবত্বের দুর্লভ সংমিশ্রণ।

এ বছরের উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ছিল দিগ্‌গজ শিল্পী পরভীন সুলতানাকে আইটিসি ও আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে আইটিসি সঙ্গীত সম্মান ২০২৫ প্রদান। এই সম্মান তাঁর অসাধারণ শিল্পসাধনা, গভীর নিষ্ঠা এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি বহন করে। এই মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননার মাধ্যমে অ্যাকাডেমি এমন এক শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানায় যার কণ্ঠস্বর যুগে যুগে শ্রোতাদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রকৃত রূপকে ধারণ করে।

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইটিসি সঙ্গীত সম্মান প্রদান করা হয়েছে ভারতের সবচেয়ে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞদের, যাদের শিল্পসাধনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে এবং যাদের নিবেদিত অধ্যবসায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সম্মান সঙ্গীতচর্চায় আজীবন অবদানের স্বীকৃতি—যা সেইসব অগ্রদূতদের প্রদান করা হয় যারা তাঁদের ঘরানার সুনাম রক্ষা করেছেন এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে সারা বিশ্বের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এ বছর পরভীন সুলতানা যুক্ত হলেন এল. সুব্রহ্মণ্যম, শিবকুমার শর্মা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, জাকির হুসেন, এন. রাজম, অজয় চক্রবর্তী, স্বপন চৌধুরী ও উলহাস কাশালকর—এই অসাধারণ সম্মানের সাম্প্রতিক লাভকারীদের গৌরবময় তালিকায়।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠত্বকে ধারণ করা শিল্পীদের সারি

আইটিসি সঙ্গীত সম্মেলন ২০২৫-এ তিন দিনে বর্ণিল পরিবেশনার এক চমকপ্রদ তালিকা সাজানো হয়েছে। এ বছরের অনুষ্ঠানে যেসব বিশিষ্ট শিল্পী পরিবেশন করছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন-

ভোকাল: পরভীন সুলতানা, অজয় চক্রবর্তী, অশ্বিনী ভি. ভিদে দেশপান্ডে, শুভ্রা গুহ, উদয় ভাওয়ালকর এবং রঞ্জনী-গায়ত্রী;

তবলা: নয়ারণ ঘোষ; সেতার ও বাঁশি: অ্যাকাডেমির প্রতিভাবান স্কলার কল্যান মজুমদার (সেতার) এবং প্রাঞ্জল ঘটক (বাঁশি), এছাড়াও আরও বহু উজ্জ্বল শিল্পী।

এই উপলক্ষ্যে মন্তব্য করতে গিয়ে আইটিসি এসআরএ-র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও ট্রাস্টি মি. শারদিন্দু দত্ত বলেন, “আইটিসি সঙ্গীত সম্মেলন হল ধারাবাহিকতার উৎসব—জ্ঞান, শৃঙ্খলা এবং শিল্পসাধনার প্রতি নিবেদনের এক উদযাপন। ২০২৫ সালের এই আসর আবারও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গভীরতা এবং প্রতিভা বিকাশে অ্যাকাডেমির অবিচল প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছে। পরভীন সুলতানা জিকে এ বছরের আইটিসি সঙ্গীত সম্মান প্রদান করতে পেরে আমরা সত্যিই গর্বিত।”

আইটিসি এসআরএ: দেশের গুরু-শিষ্য পরম্পরার এক অনন্য পরিকাঠামো

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল্যবান ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মের গুরু ও শিল্পী তৈরি করাই আইটিসি এসআরএ-র মূল উদ্দেশ্য। অ্যাকাডেমির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুগ-যুগান্তের গুরু-শিষ্য পরম্পরা, যেখানে বিশিষ্ট গুরুদের তত্ত্বাবধানে স্কলাররা পান হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উচ্চমানের ও নিবিড় প্রশিক্ষণ। অ্যাকাডেমির আবাসিক ব্যবস্থা- যেখানে শিষ্যরা গুরুর সাথে থেকেও শেখে- এই শিক্ষাপদ্ধতির মান ও প্রাচীন ধারার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। এখানে শিষ্যের কাছে গুরু শিল্পের প্রতিমূর্তি, আর গুরুর কাছে শিষ্য শিল্পের ভবিষ্যৎ। এই অমলিন প্রতিষ্ঠানটির কিছু দিগ্‌গজ গুরু হলেন- নিসার হুসেন খান (সাহসওয়ান ঘরানা), হিরাবাই বারোদেকর (কিরানা ঘরানা), ইশতিয়াক হুসেন খান (রামপুর ঘরানা), নিবৃত্তিবুয়া সারনাইক (আত্রৌলি-জয়পুর ঘরানা), গিরিজা দেবী (বেনারস ঘরানা), লতাফত হুসেন খান (আগ্রা ঘরানা), এ. কানন, মালবিকা কানন এবং আরও অনেকে।

আইটিসি এসআরএ-র শিক্ষা ব্যবস্থার মূলভিত্তি হল ঘরানাভিত্তিক সঙ্গীত প্রশিক্ষণ। প্রতিটি ঘরানার নিজস্ব সত্তা রয়েছে। যদিও একজন শিল্পী একটি ঘরানাকে প্রতিনিধিত্ব করেন, অ্যাকাডেমির পরিবেশে তিনি বিভিন্ন ঘরানার বৈশিষ্ট্যের সংস্পর্শে আসেন—যা শিল্পীর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অ্যাকাডেমি প্রতিটি স্কলারকে বেছে নেয় তাদের প্রতিভা ও নিষ্ঠার ভিত্তিতে। স্কলাররা বহু বছর ধরে গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে। স্কলার নির্বাচনে ও মূল্যায়নে থাকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি—যেখানে অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীতজ্ঞরা রয়েছেন। মূল্যায়নের ভিত্তি হয় কণ্ঠের নিয়ন্ত্রণ, গায়কী, রিয়াজ এবং পেশকারি।

শিক্ষা ও গবেষণার বাইরে আইটিসি এসআরএ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যাকাডেমি নিয়মিত কনসার্ট, সঙ্গীত উৎসব, বক্তৃতামালা আয়োজন করে এবং ছাত্র ও শিক্ষকদের অনন্য প্রতিভা সারা বিশ্বের শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরে। অ্যাকাডেমির অত্যাধুনিক লাইব্রেরি ও আর্কাইভে রয়েছে ভারতের কয়েক শতকের সঙ্গীত ঐতিহ্যের মূল্যবান বই, পাণ্ডুলিপি ও রেকর্ডিং সংগ্রহ। বর্তমানে কলকাতা এবং পুনের ক্যাম্পাসে মিলিয়ে আইটিসি এসআরএ-তে ৪০-এর বেশি স্কলার আবাসিকভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।