অসমের গোয়ালপাড়া জেলা। উত্তর-পূর্ব ভারতের একেবারে প্রান্তিক এলাকা। সেখানেই প্রায় সাতটি ফুটবল মাঠের সমান এলাকার ঘন জঙ্গল সাফ করে তৈরি হচ্ছে ভারতের প্রথম গণ আটক শিবির। অসমে চুড়ান্ত নাগরিকপঞ্জী প্রকাশিত হয়েছে। সেই তালিকা থেকে বাদ পড়া অবৈধ অভিবাসীদের স্থান হবে এই গণ আটক শিবিরে। কিন্তু ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস হল, এই শিবির যে শ্রমিকরা তৈরি করছেন তাঁদেরই অনেকের নাম নেই নাগরিকপঞ্জীতে। শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে না পারলে, তাঁদেরও জায়গা হবে এই আটক শিবিরেই।
কেন বন্দি শিবির?
অসম সরকারের দাবি প্রতিবেশী দেশ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ অবৈধ অভিবাসী এসে আশ্রয় নিয়েছেন অসমে। এনআরসি তৈরি হয়েছে মূলত তাঁদের খুঁজে বের করার জন্যই। তাদের যদি চিহ্নিত করাও যায়, তারপর তাদের কী হবে, তা অনিশ্চিত। কারণ বাংলাদেশ থেকেই এঁরা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন তা মানতে চায় না ঢাকা। তাই আইনি এনআরসি-তে নবাম না থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ না করতে পারলে তাঁদের আপাতত এই আটক শিবিরেই রাখা হবে।
নির্মাণকর্মীরাই হতে পারেন আটক
এই আটক শিবির তৈরির কাজেই যুক্ত রয়েছে স্থানীয় এক গ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়ের মহিলা শেফালি হাজং। শুধু তিনিই নন, তাঁর মা মালতী হাজং-ও এই আটক শিবির নির্মাণের কাজ করছেন। নাগরিকপঞ্জীতে তাঁদের নাম নেই। কেন নেই, তা তাঁরা জানেন না। কিন্তু মুশকিল হল, উপজাতি সম্প্রদায়ের এইসব মানুষদের অনেকেরই কাছেই কোনও বার্থ সার্টিফিকেট বা জমির দলিল ইত্যাদি নথি নেই। এই অবস্থায় ভবিষ্যত নিয়ে বেশ দুর্ভাবনায় আছেন তাঁরা। জানেন, যে আটক শিবির তাঁরা তৈরি করছেন একদিন সেখানেই জায়গা হতে পারে তাঁদের। কিন্তু তারপরেও তাঁরা বলছেন পেটের দায় বড় দায়। আটক শিবিরে কাজ করে দৈনিক মজুরি হিসেবে ২৮০ টাকা মতো রোজগার হয়। সেই রোজগারের আশাতেই আশপাশের গ্রামের অনেকেই রোজ ভিড় জমাচ্ছেন এই আটক শিবিরে।
আরও পড়ুন - চন্দ্র অভিযানে 'কলঙ্ক', এনআরসি তালিকায় নাম নেই চন্দ্রযান-২-এর বিজ্ঞানীর
আরো পড়ুন - নাম নেই শুনেই কুয়োয় ঝাঁপ বৃদ্ধার, ভুতুরে এনআরসি তালিকা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাসিন্দারা
আরো পড়ুন - অসমে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হল , নাম নেই ১৯ লক্ষ মানুষের
আরো পড়ুন - অসমে এনআরসি আতঙ্ক, মহিলাকে পাঠানো হল ডিটেনশন ক্যাম্পে
বন্দি শিবিরের অন্দর মহল
তবে শুধু এই একটি নয়, অসম জুড়ে এরকম প্রায় ১০টি আটক শিবির গড় তুলবে সরকার। এই আটক শিবিরগুলি তৈরি করা হচ্ছে সরকারি নির্দেশিকা মেনেই। গোটা শিবিরটি ঘেরা থাকবে ১০ ফুট উঁচু কংক্রিটের পাঁচিল দিয়ে। তার উপরে লাগানো থাকবে কাঁটাতার। আটক শিবিরের মধ্যেই একটি করে স্কুল, একটি করে হাসপাতাল, বিনোদনের এলাকা, নিরাপত্তা রক্ষীদের কোয়ার্টার থাকছে। গোয়ালপাড়ার আটক শিবিরে অন্তত ৩০০০ জন অবৈধঝ অভিবাসীর স্থান হবে। মোট ১৭টি বাড়ি গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিটি বাড়িতে ৩৫০ বর্গফুটের ২৪টি করে ঘর থাকছে, যেখানে বন্দিদের রাখা হবে।
শেষ কথা
তবে সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এনআরসি তালিকায় নাম নেই যাদের তাদের প্রথমেই যে বন্দি শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, তা নয়। আইনত তাঁদের হাতে নাগরিকত্ব প্রমাণের যতগুলি সুযোগ রয়েছে, তা সব ব্যর্থ হলে তবেই তাঁদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে এই বন্দি শিবিরে আনা হবে। তবে প্রাথমিকভাবে অসমের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি থাকা প্রায় ৯০০ জন অবৈধ অভিবাসীকে রাখা হবে এই বন্দি শিবিরে। গত বছর এক মানববাধিকার সংস্থা এই বন্দীদের অবস্থা পরিদর্শন করে জানিয়েছিল সাধারণ বন্দিরাও যেসব অধিকার উপভোগ করেন, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত বন্দিরা তাও পান না। তাদের মুক্তি দেওয়ার আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। যত পরিষেবাই দেওযার কথা বলা হোক আটক শিবিরেও অবস্থাটা খুব একটা পাল্টাবে বলে বিশ্বাস করছেন না কেউ। কিন্তু তারপরেও সেই শিবির গড়ার কাজই করছেন শেফালি, মালতীরা। কারণ টাকাটা খুবই দরকারি।