বিবেক অগ্নিহোত্রী (Vivek Agnihotri) পরিচালিত 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' (Kashmir Files) সিনেমাটি নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা। সেই গণহত্যা এবং বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের সাক্ষী থাকা কাশ্মীরি পণ্ডিতরা (Kashmiri Pandits) কী বলছেন?
সারা দেশে আলোচনা চলছে বিবেক অগ্নিহোত্রী (Vivek Agnihotri) পরিচালিত সিনেমা 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' (Kashmir Files) নিয়ে। বক্সঅফিসে তুমুল সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি, জনমানসেও এই ছবি বৃহত্তর প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢেকে রাখা ক্ষত আবার খুলে গিয়েছে এবং শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা। কংগ্রেস (Congress), ন্যাশনাল কনফারেন্স-সহ (National Conference) বিরোধীরা দাবি করেছে, ছবিটিতে অর্ধসত্য চিত্রিত করা হয়েছে। উল্টোদিকে বিজেপি (BJP) দাবি করছে, এই ছবি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের (Kashmiri Pandits) যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তাকেই তুলে ধরেছে। কিন্তু, কী বলছেন তাঁরা, যাঁদের সত্যি সত্যিই সেই গণহত্যা এবং বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের সাক্ষী? এশিয়ানেট নিউজের প্রতিনিধি অনীশ কুমারের কাছে মুখ খুললেন এমনই এক পরিবার।
সিনেমার কাহিনি মন গড়া নয়
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা রীতা পরিমুরের স্বামী ছিলেন ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগের (Postal and Telegraph Department) কর্মচারী। ১৯৮৯ সাল নাগাদ, পাকিস্তানি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ, উপত্যকায় বাড়াবাড়ির শীর্ষে পৌঁছেছিল। সকল সরকারি কর্মচারীদেরই কেন্দ্রীয় সরকারের গুপ্তচর হিসাবে দেখা হত। তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন সন্ত্রাসবাদীদের নজরে। রীতার স্বামী রবির সহকর্মী বিকে গঞ্জুকে সন্ত্রাসীবাদীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। বিবেক অগ্নিহোত্রীর চলচ্চিত্রে সেই হত্যাকাণ্ড নথিভুক্ত করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে সন্ত্রাসীবাদীরা ধান রাখার পাত্রে লুকিয়ে থাকা গঞ্জুকে গুলি করেছিল এবং তাঁর স্ত্রীকে সেই রক্তে ভেজা ভাত খেতে বাধ্য করেছিল। রীতা জানিয়েছেন, সিনেমায় দেখানো ওই ঘটনার এক বর্ণও বানানো নয়।
আরও পড়ুন - দ্য কাশ্মীর ফাইলস - চোখে জল অনুপম খেরের মায়ের, শোনালেন পালিয়ে আসা ভাইয়ের কাহিনি
কাশ্মীরে শৈশবের দিন
তখন হিন্দু মেয়েরা সাধারণত 'দোপাট্টা' ব্যবহার করত না। আমি কলেজে পড়ার সময় পাকিস্তান (Pakistan) থেকে কয়েকজন মৌলবী এসেছিল। দোপাট্টা ছাড়া কোনও মেয়েকে দেখলেই তারা, তাদের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতো। সেই সময়ে, মেয়েদের আঁটসাঁট পোশাক পরা ফ্যাশন ছিল। একজন মৌলবী, মহিলা কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত। যারা স্ল্যাক্স পরে আসত, সে তাদের পায়ে আঘাত করত। আমি স্কুলে শিক্ষকতা করা পর্যন্ত এই ঘটনা চলেছিল।
১৯৮৯ সালে যা ঘটেছিল
কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে তারা স্লোগান দিতে শুরু করেছিল - রলিভ, গলিভ, ইয়া চলিব, অর্থাৎ, ধর্মান্তরিত হও, মরো অথবা পালাও) (Convert, Die or Flee)। ওরা বলেছিল, কাশ্মীর পাকিস্তান হয়ে যাবে। কোনও হিন্দু (Hindu) পুরুষ, কোনও হিন্দু নারী থাকবে না। এরপরই তারা ধরে ধরে কাশ্মীরি হিন্দুদের হত্যা শুরু করেছিল। ভারত, কাশ্মীরি হিন্দু ও মহিলাদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিল। এমনকী মুসলিম শিশুদেরও, 'হাম কেয়া চাহতে, আজাদি' (আমরা কী চাই, স্বাধীনতা ) স্লোগানে মগজ ধোলাই করেছিল।
গণপ্রস্থানের কয়েক দিন আগে
আমার স্বামীকে কিছু কাজে জম্মু (Jammu) যেতে হয়েছিল। তাই তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'এখানে একা কী করবে? অবস্থা ভালো না, ভাইয়ের বাড়ি যাও'। আমি স্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম করণ নগরের (Karan Nagar) পেছন দিক থেকে বিশাল জনতা ভারত ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। এরপর বাসে করে কিছু দূর যাত্রা করার পরই, আমাদের নেমে পড়তে হয়েছিল। কারণ বাস আর এগোতে দেওয়া হয়নি। আমার কোলে আমার সন্তান ছিল। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আটকে গিয়েছিলাম। তারা সবাই ঘিরে ধরে স্লোগান দিচ্ছিল।
আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, দিনের শেষে হয় আমি অথবা আমার সন্তান বেঁচে থাকবে। তবে, একরকম সময়ে একটা অটোরিকশা আমাদের রায়নাওয়ারীতে (Rainawari) আমার ভাইয়ের বাড়িতে নামাতে রাজি হয়েছিল। কোনোরকমে সেখানে পৌঁছে দেখলাম, পাশের এক মসজিদ থেকে ঘোষণা করা হচ্চে, 'জলে বিষ মেশানো হয়েছে, খাবেন না'। এরপরই উপত্যকায় তিন দিনের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছিল। পরদিন খুব ভোরে জম্মু থেকে ফিরে, আমার স্বামী তাঁর স্কুটারে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন দরজা ধাক্কিয়েছিলেন, আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বোধহয় সন্ত্রাসবাদীরা এসেছে। করণ নগরের বাড়ি ফেরার সময় আমরা লাল চকের (Lal Chowk) কাছে পৌঁছে দেখেছিলাম গুলি চলছে। আমার স্বামী তার স্কুটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কীভাবে যে বাড়িতে পৌঁছেছিলাম, তা আর মনে নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা গুপ্তচর
আমার স্বামী শ্রীনগরের (Srinagar) ডাক ও তার বিভাগে কর্মী ছিলেন। সন্ত্রাসীবাদীরা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুপ্তচর বলে সন্দেহ করত। ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি রাতে হাজার হাজার মুসলমান রাস্তায় নেমে আসে। 'আল্লাহ হু আখবার' স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল চারিদিক। আমাদের দরজাতেও ক্রমাগত ধাক্কা মারছিল। শুনলাম হিন্দুদের ধরে ধরে বের করে দেওয়া হচ্ছে। আমার স্বামী বললেন, তিনি বাইরে যাচ্ছেন। কোনও সমস্যা হলে, আমাদের মুসলিম (Muslim) প্রতিবেশীর বাড়িতে যেতে বললেন।
বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে গেলেও তিনি না ফেরায় আমরা দারুণ চিন্তায় পড়েছিলাম। লাউডস্পিকারের ঘোষণা করা হয়েছিল 'নিজেদের বাঁচাতে চাইলে, স্ত্রীদের এখানে রেখে পালিয়ে যাও'। পরে শুনেছিলাম, নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে আমার স্বামী এবং অন্যান্য হিন্দু পুরুষদের ওরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। আমার স্বামী কোনওভাবে সেখান থেকে পালাতে পেরেছিলেন। ওই রাতে অনেক কাশ্মীরি হিন্দু ভয়ে উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আমার পিসিও চলে গিয়েছিলেন। আমার স্বামী সরকারি চাকুরিজীবী হওয়ায়, থেকে যান। সরকারি কর্মীদের অনেকেই মুসলমানদের হাতে খুন হয়েছিলেন।
বিকে গঞ্জু হত্যা
একদিন, আমার স্বামী অফিসে গিয়েছিলেন। আমার স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি বাড়িতেই থাকতাম। রোজ তিনি বিকেল ৪টের আগে ফিরে আসতেন, কিন্তু সেদিন আসেননি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও তিনি না আসায়, আমি চিন্তায় পড়েছিলান। হঠাৎ দেখি, আমাদের বাড়ির সামনে একটি আর্মি জিপ এসে থামল। আমার স্বামীকে সেই জিপ থেকে নামতে দেখলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'কী হয়েছে?'
তিনি বলেছিলেন, তাঁর সহকর্মী গঞ্জুকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, তিন থেকে চার দিন আগেই সন্ত্রাসবাদীরা তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। তাদের সন্দেহ ছিল, গঞ্জু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁদের তথ্য ফাঁস করছে। সন্ত্রাসবাদীরা আরও বলেছিল, যারা তাঁর শেশকৃত্যে অংশ নেবে, বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুঃখ ভাগ করে নেবে, তাদেরেও হত্যা করা হবে। কিন্তু, আমরা কীভাবে তাদের ছেড়ে যেতে পারতাম? ওঁর এক বছর বয়সী এক সন্তান ও স্ত্রী ছিল (চোখের জল ধরে রাখার চেষ্টা করেন রীতা)।
গঞ্জু সরকারের কাছে একটি গাড়ি পাঠানোর অনুরোধ করেছিল। যাতে সে নিরাপদে উপত্যকা থেকে বের হতে পারে। কিন্তু, কেউ তাঁর কথা শোনেনি। সকাল ১০টার দিকে সন্ত্রাসবাদীরা তাঁর দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। তাঁর স্ত্রী তাঁকে একটা বড় চালের ড্রামে লুকিয়ে রেখেছিল। সন্ত্রাসীরা তাঁকে খুঁজে পায়নি। তারা যখন ফিরে যাচ্ছিল, তখন তাদের একজন জানিয়েছিল যে সে ড্রামের মধ্যে লুকিয়ে আছে। সন্ত্রাসীরা ওই ড্রামের গায়ে ছয়টি গুলি ছুড়ে গঞ্জুকে হত্যা করেছিল।
কাশ্মীর ছেড়ে জম্মুতে
১৯৯০ সালের ২০ মার্চ, আমার স্বামী আমাকে শহর ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। আমাদের প্রতিবেশী একজন অটোরিকশা চালককে চিনতেন। তাকে ফোন করে এবং ভোর ৩টের সময় আমরা বাড়ি থেকে শ্রীনগর বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। ভোর ৫টায় বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখেছিলাম হাজার হাজার মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওইদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত আমার বাচ্চাকে কিছুই খাওয়াতে পারিনি। দুপুর দেড়টার দিকে আমরা মাত্র একটি ব্যাগ নিয়ে জম্মুর উদ্দেশ্যে বিমানে উঠেছিলাম।
আমরা ভাগ্যবান যে জম্মুতে আমরা শ্যালকের বাড়ি ছিল। আমরা সেখানেই উঠেছিলাম। অধিকাংশ মানুষই তাঁবুতে থাকত। কয়েক মাস পর, আমরা দিল্লিতে আসি এবং তারপর আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই অনেক সংগ্রাম করেছি। এখন, আমরা ভালোই আছি।
স্থানীয় মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া
আমাদের প্রতি তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। অদ্ভূতভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল পরদিন সকালেই কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হবে। এই ছিল তাদের মনোভাব। তাদের মধ্যে কিছু ভাল লোকও ছিল। তাদের জন্যই আমরা উপত্যকায় আরও দুই মাস থেকে গিয়েছিলাম।