
ভারতের সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তেজস যুদ্ধ বিমানের এয়ার শো চলাকালীন ঘটে যায় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। যা এক গর্বের মুহূর্ত হওয়ার কথা ছিল, শুক্রবার বিকেলে সেটাই পরিণত হলো জাতীয় হাহাকারে। দুবাই এয়ার শো-তে (Dubai Air Show) একটি IAF তেজস (Tejas) যুদ্ধবিমানের প্রদর্শন চলাকালীন সেটি ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সময় দুপুর ২টো ১০ মিনিট নাগাদ বিমানটি একটি নিম্ন উচ্চতার কসরৎ (low-altitude manoeuvre) শেষ করার ঠিক পরেই নীচে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেটি এক বিশাল আগুনের গোলায় (massive ball of fire) পরিণত হয়ে বিস্ফোরিত হয়। এই ঘটনায় মুহূর্তে গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এই বিষয়ে একান্ত সাক্ষাতকারে এয়ার মার্শাল অনিল চোপড়া দিনটিকে কেবলমাত্র ভারতীয় বিমান বাহিনীর (IAF) জন্য নয়, বরং দেশের মহাকাশ যাত্রার জন্য একটি শোকাবহ বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “একটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি একক-ইঞ্জিনের যুদ্ধবিমান নিয়ে বিদেশী মাটিতে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা।”
তিনি আরও বলেন যে, ‘’বিমান এবং পাইলট উভয়েরই অসামান্য যোগ্যতা ছিল। এই কর্মসূচি, যা এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সফলভাবে চলছিল, তার নিরাপত্তার রেকর্ড ছিল খুবই উচ্চ। পাইলট ছিলেন খুবই পেশাদার একজন বিমানচালক, যাঁকে বিশেষ করে নির্বাচন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এবং যিনি বহুবার অ্যারোব্যাটিক কৌশল ও ডিসপ্লে প্রোফাইল অনুশীলন করেছিলেন। আমরা একজন সাহসী সৈনিককে হারালাম। পরিবারকে আমাদের সমবেদনা ও স্যালুট।”
তেজস দুর্ঘটনায় শহদ হলেন হিমাচল প্রদেশের পাইলট। বিমান দুর্ঘটনায় একমাত্র পাইলট, উইং কমান্ডার নামাংশ স্যাল (Wing Commander Namansh Syal) নিহত হয়েছেন। হিমাচল প্রদেশের বাসিন্দা এই পাইলটের বয়স ছিল তিরিশের কাছাকাছি। আল মাকতুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Al Maktoum International Airport)-এর কাছে যেখানে বিমানটি আছড়ে পড়ে, সেই স্থান থেকে ঘন কালো ধোঁয়া (thick black smoke) কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে দেখে স্তম্ভিত দর্শকরা (shocked spectators) অসহায়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। ইতিমধ্যে যে ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল (viral) হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধবিমানটি হঠাৎ করেই দ্রুত উচ্চতা হারাচ্ছে এবং তারপরেই মাটিতে সজোরে আছড়ে পড়ছে। সেখানে উপস্থিত অনেকের কাছেই এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও মর্মান্তিক। উইং কমান্ডার সিয়াল ছিলেন উচ্চ প্রশিক্ষিত একজন ডিসপ্লে পাইলট, যাকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং তিনি যে অ্যারোব্যাটিক সর্টিটি প্রদর্শন করছিলেন, সেটির জন্য তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মহড়া দিয়েছিলেন। প্রদর্শনটি আট মিনিট ধরে চলার কথা ছিল বলে জানা গিয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে দুবাইতে তেজস যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পাকিস্তানি এর বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচার চালাতে থাকে। এই অপপ্রচারের জবাবে ভারতীয় সামরিক বিশেষজ্ঞ চোপড়া তাঁর স্বভাবসিদ্ধ তীব্র ভাষায় তা খারিজ করে দেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, সম্প্রতি সামরিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের যে বিপর্যয় ঘটেছে-"তারা সবেমাত্র ভারতীয় বিমান বাহিনীর কাছে 'অপারেশন সিঁদুর'-এর মাধ্যমে একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। এতে প্রায় ২০ শতাংশ পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং তাদের সক্ষমতা অনেক পিছিয়ে গেছে।"
এই বিষয়ে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক চোপড়া পদ্ধতিগতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কেন ভারতের তেজস বিমানটি পাকিস্তানের JF-17-এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাঁর মতে:
"তেজস একেবারেই ভিন্ন শ্রেণীর বিমান... সামগ্রিকভাবে এটি একটি ৪.৫ প্রজন্মের বিমান, যা JF-17-এর থেকে অনেক এগিয়ে।"
তিনি আরও মনে করিয়ে দেন যে JF-17 বিমানটি বহিরাগত প্রযুক্তির ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল।
"এর মৌলিক প্রযুক্তি, ইঞ্জিন, রাডার—সবকিছুই বাইরে থেকে নেওয়া... মূলত চিনের সরাসরি সমর্থনের কারণেই এটি তৈরি সম্ভব হয়েছে।"
তুলনামূলকভাবে, তেজস তৈরি হয়েছে অনেক বেশি স্বদেশী প্রচেষ্টার মাধ্যমে—যদিও এর ইঞ্জিন আমদানিকৃত।
"ইঞ্জিনের জন্য আমাদেরও আমেরিকার GE404 ইঞ্জিনের ওপর নির্ভর করতে হয়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিমানটি অনেক এগিয়ে।"
দুবাই এয়ার শোতে ভারত থেকে যে তেজস এমকে ১ যুদ্ধ বিমান পাঠান হয়েছে তার জ্বালানি লিক করছে।- এই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই বক্তব্যের পক্ষে বেশ কিছু ছবি আর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাতেও দেখা গিয়েছিল তেজস থেকে তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়ছে। এই খবর ভুয়ো বলে উড়িয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। পিআইবি-র তরফ থেকে জানান হয়েছিল, এই খবর সম্পূর্ণ ভুয়ো। ভিডিওতে যে তলব দেখা গিয়েছে তা আদৌ তেল নয়, জল। ইচ্ছেকৃতভাবেই জল ছড়়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এটি একটি নিয়মমাফিক প্রক্রিয়া।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ ভিডিও দেখে জানিয়েছিল, শূন্যে তেজস যুদ্ধ বিমান নিয়ে একটি কৌশল দেখানোর পরিকল্পনা ছিল পাইলটের। তা ব্যারেল রোল নামে পরিচিত। এই কৌশলে জেট একবার পাল্টি খেয়ে আবার সোজা হয়। তারপর গোলাকার কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এটি একটি কঠিন কৌশল। পাইলটকে কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধ বিমানের মধ্যেই উল্টে থাকতে হয়। এয়ার শোতে পাল্টি খেতেই তেজস যুদ্ধ বিমানে আগুন লাগে বলে প্রাথমিক অনুমান।