পূর্বালোক এলাকায় এখন বড় মাঠ বা পুকুর বলে কিছুই নেই। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ল্যান্ড মাফিয়া ও প্রোমোটরদের দাপটে কংক্রিকেটের বেড়াজালে পরিণত হয়েছে এককালে ইস্ট-ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ডের অধীনে থাকা এই এলাকা।
একেই বলে যে রক্ষক সেই ভক্ষক। সংস্থার গালভরা নাম- কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (Kolkata Environmental Improvement Investment Programme) । সংক্ষেপে কেইআইআইপি (KEIIP)। যাদের কাজ হল পরিবেশকে রক্ষা করে নগরায়ণ (Urbanisation)। এহেন কেইআইআইপি এখন প্রায় আড়াই বিঘে জলাভূমি বুঝিয়ে নোংরা জল নিস্ক্রমণ পাম্পিং ট্যাঙ্ক করার কাজে নেমেছে (Filling Water Body Illegally)। অথচ, এই জলাভূমির পাশেই পড়ে রয়েছে বিশাল জমি। এর মধ্যে সিংহভাগ জমির মালিক আবার তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ যোগেন চৌধুরীর ফাউন্ডেশন (TMC MP Yogen Chowdhury)। যেখানে ১৫ বছর ধরে পরিকল্পনা হয়েই চলেছে যে আন্তর্জাতিকমানের আর্ট কলেজ তৈরির। ২০১৭ সালে জমি থেকে খেলার মাঠকে উৎখাত করে রাতারাতি ঘিরেও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ,তারপরও কেটে গিয়েছে ৪টা বছর। এখনও যোগেন চৌধুরীর আর্ট কলেজ বাস্তবায়িত হয়নি। এখন বয়স কত যোগেনবাবুর? উইকিপিডিয়ার (Wikipedia) হিসাব বলছে ৮২ বছর। তারমানে উনি যখন জমি নিয়েছিলেন তখনই ৬৫ বছরের কোটা পার করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে (Left Government) উল্টে দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন সরকারের কাছ থেকে জমি নিলে ৩ বছরের মধ্যে প্রকল্প চালু করতে হবে। যোগেন চৌধুরীর পাশেই রয়েছে আরও এক সংস্থার জমি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) সরকারের কাছ থেকে তারা এখনও জমির মালিকানা হাসিল করতে পারেননি।
এবার আসা যাক আসল কথায়। পূর্বালোক এলাকায় এখন বড় মাঠ বা পুকুর বলে কিছুই নেই। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ল্যান্ড মাফিয়া ও প্রোমোটরদের দাপটে কংক্রিকেটের বেড়াজালে পরিণত হয়েছে এককালে ইস্ট-ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ডের অধীনে থাকা এই এলাকা। এলাকার ফুঁসফুঁস বলতে ছিল এই কয়েক বিঘা জমি এবং তার সংলগ্ন প্রায় দুই বিঘা এলাকা জুড়ে জলাশয়। এলাকায় পুজো-পার্বন থেকে শুরু করে অগ্নিসংযোগের মতো কোনও ঘটনা ঘটলে এই জলাশয় একমাত্র অবলম্বন। দীর্ঘদিন কয়েক দশক ধরে এই এলাকায় বসবাসকারী বারবার দাবি তুলেছিলেন পুকুর-এর চারপাশে সৌন্দর্যায়ন করে একটি পার্কের মতো করে দিতে। যাতে এলাকার মানুষ সেখানে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারেন। এই জলাশয়কে ঘিরে এখানকার জীববৈচিত্র বড় আকর্ষণের। এখানে কম করে ২০ থেকে ৩০ ধরনের পাখির ১২ মাসের বাস। বড় বড় সারস থেকে শুরু করে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখির দল এখানে আনাগোনা করে খাবারের সন্ধানে। যার জন্য গুগল ম্যাপে একে পাখি সরোবরের তকমাও দেওয়া হয়েছে।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এলাকার বিশেষ করে মুকুন্দপুর, কালিকাপুর, নয়াবাদ এলাকার মূল সমস্যা জল নিস্ক্রমণ। এই এলাকাগুলো আগে কলকাতার জমা জল বের হওয়ার গেটওয়ে হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন সেখানে নগরায়ণ হওয়ার ফলে জল বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ। এর জন্য কয়েক বছর ধরে সরকার এইসব এলাকায় বর্জ্য জল নিস্ক্রমণের একাধিক পীঠ বানানোর পরিকল্পনা নিতে শুরু করে। কিন্তু, সে সময় এই প্রকল্পের কার্যকারিতা এবং পরিকল্পনাকে ঘিরে পরিবেশবিদরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। যার ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যত অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কারণ, মুকুন্দপুর, কালিকাপুর, নয়াবাদ- এই এলাকাগুলো শুধু নিচু নয়, একটা একটা এলাকা একে অপরের থেকে কোথাও উচু আবার কোথাও নিচু। স্বাভাবিকভাবেই জল বর্জ্য জলের পীট থেকে পাম্প করে জল কীভাবে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলা হবে তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল সরকারের পরিকল্পনা।
সম্প্রতি এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে বর্জ্য জল নিস্ক্রমণের আর্থিক অনুদানে সবুজ সঙ্কেত পেতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে সরকার। কিন্তু প্রকল্পের জন্য যে জমি-কে চিহ্নিত করা হয়েছিল, রহস্যময় কারণে তা রাতারাতি বদলে ফেলে কেইআইপি। যে জমিতে প্রথমে এই প্রকল্প প্রথম তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তা ছিল মুকুন্দপুরের বারাখোলা মৌজার জিএল নম্বর ২১-এর অধীনে ১৩৬ নম্বর প্লটে।
কিন্তু, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে প্রকল্পের স্থান নিয়ে আসা হয় পূর্বালোকের পাখি জলাশয়ে। এর জন্য কিছু ফিজিবিলিটি স্টাডির তথ্য তাদের প্রকল্পের মধ্যে তুলেও দেয় কেআইপি। এখানে বেশকিছু মানুষের নাম এবং ফোন নম্বরও দেয় তারা। দাবি করা হয় এরা এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এদের মধ্যে অনেকেই ওই জলাশয়ের আশপাশে বসবাস করেন না। এমনকী, ফিজিবিলিটি স্টাডিতে কথা বলা অধিকাংশ লোকই তৃণমূল কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী।
বর্তমান পরিবেশ আইন অনুযায়ী কোথাও জলাশয় বুঝিয়ে কাজ করতে গেলে তার পাশে আর একটি কমপেনসেটারি জলাশয় তৈরি করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কেআইপি তাদের প্রজেক্ট রিপোর্টে জানিয়েছে যে নয়াবাদ এলাকায় তারা এই জলাশয় তৈরি করবে। নয়াবাদেও জলাশয় বুঝিয়ে নির্মাণ বহুদিনের সমস্যা। আর নয়াবাদের কোথায় সেই জলাশয় হবে তার কোনও উল্লেখ প্রজেক্ট রিপোর্টে করা হয়নি। আর পূর্বালোক এবং নয়াবাদের মধ্যে দূরত্ব কম করেও ২ কিলোমিটার। এমন হাস্যকর প্রজেক্ট রিপোর্ট কীভাবে কেইআইআইপি-র মতো একটি পেশাদার সংস্থা বানাতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য়।
পূর্বালোকের পাখি জলাশয়ের উপরে ১৯৫৮ সাল থেকে রিসিভার বসিয়ে রেখেছে আদালত। জানা গিয়েছে এই জলাশয় এবং তার সংলগ্ন এলাকার অধিকাংশটাই ছিল মণ্ডলদের সম্পত্তি। কিন্তু, স্বাধীনতার পর সরকার এই জমি নিয়ে নেয়। এই নিয়ে ১৯৫৬ সালে আদালতে মামলা করেছিল মণ্ডল পরিবার। সেই মামলার প্রেক্ষিতে বসানো হয়েছিল রিসিভার। বাম আমলে সরকার এই জলাশয় এবং তার সংলগ্ন জমিকে ভেস্টেড বলে চিহ্নিত করে দেয়। সেই নিয়েও রাজ্য সরকার বনাম মণ্ডলের মামলা শুরু হয়। আদালত পরিস্কার জানিয়েও দিয়েছিল মণ্ডলদের সঙ্গে চলা এই মামলার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জমির স্ট্যাটাসকো উভয়পক্ষকেই বজায় রাখতে হবে। পূর্বালোকের পাখি জলাশয় এবং তার সলংগ্ন জমির রিসিভার ছিলেন অশোক রায়। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হন। মণ্ডল পরিবারে অভিযোগ এই সুযোগে জলাশয় ভরাট করে তা দখল করছে সরকার।
স্থানীয় বেশকিছু মানুষেরও অভিযোগ, কিছু না জানিয়েই অক্টোবরে দুর্গাপুজোর সময়ে আচমকাই জলাশয়ের ৯০ শতাংশ এলাকায় শালবরগার খুঁটি দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে কেইআইপি। প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয় কলকাতা পুরসভার ১০৯ ওয়ার্ডের তৎকালীন প্রশাসক অন্যন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যদিও এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অন্যন্যা জানিয়েছিলেন এই প্রকল্পের কথা তিনি সেভাবে জানেন না। কেইআইপি প্রকল্প করছে।
অথচ, কলকাতা পুরভোট শুরু হতেই এখন জলাভূমি ভরাট করে নোংরা জলের এই পাম্পিং স্টেশন তৈরির কৃতিত্ব দাবি করে পূর্বালোক এলাকায় পোস্টারিং করেছেন অন্যন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিনভর তিনি জলাশয় সংলগ্ন এলাকায় মাইক বাজিয়ে দাবি করছেন পরিবেশ বাঁচিয়ে তিনি উন্নয়নের স্বাদ এলাকাবাসীকে দিতে চান। কিছু এলাকাবাসীর অভিযোগ, একটা বিশাল জলাশয়কে বুজিয়ে যে নোংরা জলের পাম্প স্টেশন বানানোতে কি পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে না? অন্যন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরও দাবি করেছেন তাঁরা। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডে বহু অনৈতিককাজে অন্যন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদত ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। কাউন্সিলার হওয়ার পর থেকেই এলাকায় গাছ কেটে ফেলা থেকে শুরু করে জলাশয় ভরাট, অর্থ নিয়ে জলের ফেরুল বাড়াতে অনুমতি দেওয়া-সহ একাধিক গুরুতর অভিযোগ নানা সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে। এমনকী, খোদ পূর্বালোকেই উন্নয়নের প্রশ্নে বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন বলেও অভিযোগ। যার ফলে পূর্বালোক একটি অংশে সামান্য বৃষ্টিতেও জলের তলায় চলে যায় বলে অভিযোগ।
অক্টোবর মাসেই এশিয়ানেট নিউজ বাংলা কথা বলেছিল কলকাতা পুরসভার তৎকলানীয় পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য তারক সিং-এর সঙ্গে। তখন বর্জ্য জল নিস্ক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি। ভরাট জলাশয় বুজিয়ে বর্জ্য জল নিস্ক্রমণের পীঠ বানানোর কোনও পরিকল্পা নেই বলেই সে সময় দাবি করেছিলেন তারক সিং। এমনকী. এই নিয়ে তাঁর কাছে কোনও তথ্য নেই বলেও দাবি করেছিলেন কলকাতা পুরসভার পরিবেশ রক্ষা বিভাগের ডিআইজি।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক কেআইপি-র সৌম্য গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেও যোগোযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি এই নিয়ে কোনও তথ্য দিতে অস্বীকার করেন এবং কেআইপি-র ডিরেক্টর-এর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু, কেইআইপি-এর ডিরেক্টর-এর সেক্রেটারি কোনও ধরনের অ্যাপয়মেন্ট দিতে অস্বীকার করেন।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এডিবির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের উত্তরও এখনও এসে পৌছয়নি। কীভাবে একটি বিশুদ্ধ জলাশয়-কে বুঝিয়ে নোংরা জলের পীঠ বাবানো যায় এবং এটা কী ধরনের পরিবেশ রক্ষা- তা নিয়েও এই কমিউনিকেশনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
স্থানীয় কিছু মানুষের অভিযোগ, সরকার নিজেই জলাশয় ভরাট করার মতো অপরাধ করেছে তা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারছে না। কারণ, এই প্রতিবাদের ফল যে ভালো হবে তা নাকি হারে হারে বুঝিয়ে দিয়েছেন কলকাতা পুরভোটে কাউন্সিলার পদপ্রার্থী অন্যন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্টজনেরা। ফলে কেউ মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে বলে অভিযোগ। এমনকী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা নিয়েও এক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। চোখের সামনে গাছ উপরে, মাটি ফেল জলাশয় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথচ প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না। এতে তারা আরও অসহায় বোধ করছেন বলেও দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন--
-------------------
KMC Election 2021: পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে আর্জি জানান হাইকোর্টে, বিজেপিকে বলল সুপ্রিম কোর্ট
Dilip TMC Manifesto: বিজেপিকে অনুসরণ করে পুরভোটের ইস্তেহার প্রকাশ করছে তৃণমূল, দাবি দিলীপের
KMC Polls 2021: দোরগড়ায় পুরভোট, 'নকল আধার কার্ড' ইস্যু তুলে তৃণমূলকে তোপ শুভেন্দুর