সংক্ষিপ্ত
- অভিনয়কে একটি অন্যমাত্রায় নিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
- তিনি প্রথম স্ক্রিন টেস্টে বাদ পড়েছিলেন
- তারপরেও লড়াই চালিয়ে ফিরে এসেছিলেন
- লড়াকু মনোভাব তাঁকে থামাতে পারেনি
তপন মল্লিক
বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি তিনি। এই উপমহাদেশে যে ক’জন অভিনেতা মেধায় আর সাবলীলতায় অভিনয়কে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। শুধু তাই নয়, বাংলা সিনেমার মহানায়কের কালেও তিনি স্বতন্ত্র একজন অভিনেতা, বাঙালি হৃদয়ে এই মানুষটি আলাদা সম্মান আর সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কারণে।
জাদরেল অভিনেতাটি প্রায় ষাট বছরের অভিনয় জীবনে তিনশোর বেশি ছবিতে লাগাতার অভিনয়ে তাক লাগিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্র অনুরাগীদের। একই সঙ্গে তিনি নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন। থিয়েটারে তাঁর অভিনয় যেমন মনোপ্রিয় তেমনই তাঁর কবিতা পাঠে মুগ্ধ বাঙালি দর্শকরা। একসময় ‘এক্ষণ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তার চিত্রশিল্পী পরিচয়ও অনেককের কাছে বিস্ময়কর।
তাঁর প্রথম ছবি হতে পারত ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’। সব কথাই পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্ক্রিন টেস্টে বাদ পড়ে যান তিনি। অবশেষে সত্যজিৎ রায় নিজেই ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং সেটে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপের সময় বলেন, ‘এই হল সৌমিত্র। আমার পরবর্তী ছবি অপুর সংসারে ও অপু করছে’।
তারপরের অধ্যায়টা ইতিহাস। ‘অপুর সংসার’-এ ফার্স্ট শটেই সিন ওকে। একে একে ‘দেবী’, ‘চারুলতা’, ... সত্যজিতের ১৪টি ছবির তিনি অন্যতম অভিনেতা তিনি। অভিনয় করেছিলেন তিনি।
সত্যজিতের ফেলুদাকে জীবন্ত করেছিলেন তিনিই। পরেও বহুবার হয়েছে বড় পর্দায়, ছোট পর্দায়। কিন্তু এমন কোনও বাঙালি নেই যিনি একবাক্যে স্বীকার করবেন, সৌমিত্রের মতো কারও পক্ষে ওই চরিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৬-৮৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি ছোটোগল্পকে কেন্দ্র করে দূরদর্শনের জাতীয় চ্যানেলে একটি টেলিভিশন সিরিজ হয়েছিল। হিন্দি তে। তার মধ্যে একটি ছিল 'স্ত্রীর পত্র' অবলম্বনে "স্ত্রী কা পত্র"। এই ছবিটির পরিচালক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ওই কাজের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ পরিচালক নির্বাচিত হয়ে আজকাল টেলিভিশন পুরস্কার পান। এর পরও ছবি পরিচালনার সুযোগ থাকলেও তিনি আর উৎসাহিত হন নি।
আসল অস্ত্রটা হল মগজ, গ্রে ম্যাটার অথবা অ্যাকাডেমিক ইনটেলিজেন্স। সেটা ওই ধারালো, কাটা–কাটা চোখমুখে একটা বাড়তি প্রত্যয় বলে নয়। হয়ত সে কারণে হরে মুরারে মধুকৈটভহারে বলে ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে পড়া যায় কিন্তু বেলাশেষেও যে মুখমণ্ডল থেকে আশ্চর্য সৌম্যকান্তি বিচ্ছুরিত হয়। সেটা চেহারা–ছবি ছাপিয়েও অন্যকিছু। যা এমনিতে দেখা যায় না। কিন্তু কোনওকিছুর উপর পড়লে তার ঝলমলে অস্তিত্ব বোঝা যায়।
অভিনয়ে মাপা বুদ্ধি স্পষ্ট ফুটে ওঠে। যেমন কথাবার্তায় থাকে পড়াশোনার ছাপ। বাংলার আর কোনও অভিনেতার স্বাভাবিক আলাপে এমন বিদ্যাবত্তার পরিচয় মেলে না। কারও বাচনভঙ্গিতে থাকে না এমন গভীর অধ্যয়নের ছায়া।
আসলে তিনি যে ফেলুদা। মানে মগজাস্ত্র। সে কথা তো অনেকদিন আগেই বারাণসীর এক চিলেকোঠার ঘরে বালক রুকুকে বলেছিলেন। তাঁর সমস্ত কাজে–ভাবনায় চেতন–অবচেতনে সেটা কাজ করে। সেই মগজ দিয়েই তিনি বোঝেন ক্যামেরার সামনে কতটা উচ্চকিত হবেন। কতটা শান্ত থাকবেন। তাই একমাত্র তিনিই তীব্র ঘৃণায় অধর কুঞ্চিত করে উচ্চারণ করতে পারেন- ‘বান্দার বাচ্চা!’ তাঁর উচ্চারণেই প্রৌঢ়ের জানকবুল আহ্বান- ‘ফাইট কোনি ফাইট!’যথার্থ মাত্রা পায়। কিংবা মশালের আলোয় তলোয়ারের ফলার মতো প্রতিবাদী জ্বলন্ত দু’চোখ আর একজন সাধারণ শিক্ষক কেটে কেটে বলছেন— ‘অনাচার করো যদি, রাজা তবে ছাড়ো গদি। যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারী’। হ্যাঁ, একমাত্র তিনি বলতে পারেন বলেই তাঁকে কোনও জুটি বাধতে হয় না। নায়ক কিংবা মহানায়কের তকমায় আটকে পড়তে হয় না।
নিরন্তর নিজের ভেতর নিজস্ব নির্মেদ মগজকে শান দিয়েছেন। তাতে বেড়েছে মেধা-ধীশক্তি। কিন্তু এটা কি ঠিক যে, বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব মৃত্যুঞ্জয় শীল না থাকলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামক নক্ষত্রের উদয়ই হত না বাংলার নাট্যাভিনয়ের আকাশে। এটা লোকশ্রুতি। ১৯৫৮ সালে ব্যক্তিগত কারণে একটি নাটকের লিড রোল থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তখন খ্যাতির তুঙ্গে থাকা মৃত্যুঞ্জয়। নিজের জায়গায় এগিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু সৌমিত্রকে। হবে হয়ত। কিন্তু এভাবেই দরজা খুলে দেয় নিয়তি। সিনেমায় অভিনয় শুরুর দু’দশক পর বিশ্বরূপায় ‘নামজীবন’ নাটক নিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। তারপর একে একে ‘ফেরা’ থেকে ‘হোমাপাখি’তে মঞ্চ জুড়ে করেছেন দাপাদাপি।
সাড়ে পাঁচ দশক ধরে অভিনয়ের শাখা-প্রশাখায় বিরামহীন তার পথচলা। সমসাময়িককালে তিনিই একমাত্র অভিনেতা, যিনি একাধারে সেলুলয়েড-থিয়েটার-টেলিভিশনে কাজ করছেন এবং ধরে রেখেছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের খ্যাতির পাশে কবি স্বত্বা আড়ালে পড়ে না। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’ ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে’ ‘শব্দরা আমার বাগানে’ ‘যা বাকি রইল’ ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’ ‘ধারাবাহিক তোমার জলে’ উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে এমন আরেকজন বাঙালি কি খুঁজে পাওয়া যাবে!