সংক্ষিপ্ত

  • জোছন দস্তিদারের হাত ধরে বাংলা টেলি জগৎ পেয়েছিল ভিন্নতার ছোঁয়া
  • ডিডি বাংলার 'তেরো পার্বণ' আজও দর্শকের মণিকোঠায়
  • হঠাৎ কেন এমন বদল ঘটল বাংলা বিনোদন জগতে
  • 'কিরণমালা' থেকে 'কে আপন কে পর', কোথা থেকে এল এই পরিবর্তন

টেলিভিশন অর্থাৎ টিভি। টিভির আরও একটি বহু প্রচলিত নাম রয়েছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ইডিয়ট বক্স। অনেকের মতে পুরনো টিভির মডেল হোক বা এখনকার স্মার্ট টিভি, কোনটাতে থেকেই আশা করা যায় না শিক্ষনীয় বিষয়ের। এই বক্তব্যে যারা বিশ্বাসি তারা এও জানেন, এই কথাটি খানিকটা হলেও ভুল। টেলিভিশনের এমন একটি সময় ছিল যা অত্যন্ত মধুর। যার থেকে কেবল নিখুঁত বিনোদনই নয়, ছিল শিক্ষার ছোঁয়া। সেই সময় অবশ্য হারিয়েছে। এবার প্রশ্ন আসে, বিনোদন বলতে ঠিক বুঝি আমরা। আমার, আপনার, সমাজের আর পাঁচজনের মানুষের বিনোদনে স্বাদ কি একরকম। একেবারেই নয়। বরং আপনি যদি 'দাদাগিরি' থেকে বিনোদনের সন্ধান পান তাহলে আর একজন ব্যক্তি হয়তো 'দিদি নম্বর ওয়ান'র খেলাগুলি দেখে মনোরঞ্জিত হচ্ছেন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন একই ধরণের বিনোদন তাড়িয়ে তাড়িয়ে আস্বাদন করত। 

জোছন দস্তিদার
জোছন দস্তিদার। আশা করি নামটা মনে আছে। প্রশ্নটি অবশ্যই 'জেন ওয়াই' কিংবা 'জেন এক্স'র মানুষদের জন্য নয়। ৩০-এর কোটা পেড়িয়ে গিয়েছেন যারা প্রশ্নটি তাদেরই জন্য। বাঙালির কাছে এই যদি নামটি মনে করিয়ে দিতে হয় তাতে অবশ্যই খারাপ লাগে বই কি। এই জোছন দস্তিদারের হাত ধরেই বাংলা বিনোদন জগতে আসে নয়া জোয়ার। ধারাবাহিক। চেনা-জানা ভাষায় যাকে বলে সিরিয়াল। জিনিসটা কী। খায় না মাথায় দেয়। তা বাঙালি দর্শককে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই ধারাবাহিক কনসেপ্ট ভাঙিয়ে খাচ্ছে অগণিত মানুষ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, প্রযোজক তথা প্রযোজনা সংস্থা। মেয়ে খেয়ালী দস্তিতার, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইন্দ্রাণী হালদার সহ অনেককে নিয়ে শুরু হয় এই বাংলা ধারাহিক। যা আমূল পরিবর্তন আনে বাংলা টেলিভিশন জগতে। 

 

 

বাংলা ধারাবাহিকে আমূল পরিবর্তন
'তেরো পার্বণ' ছিল সূচনা। আশির দশেকর শেষের দিকে শুরু হয়েছিল এই ধারাবাহিক। তারপর ধীরে ধীরে আসতে থাকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে তৈরি হয় 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন মনোজ মিত্র, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি 'সেই সময়'। জোছন দস্তিদার এই ধারাবাহিকে প্রযোজনা করার পাশাপাশি অভিনয়ও করেন। অনুপ্রাণিত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষও নিয়ে এলেন 'বাহান্ন এপিসোড'। নব্বই দশকের এই ধারাবাহিক আজও কাল্ট হিসাবে পরিচিত। গার্গী রায়চৌধুরী ছিলেন প্রধান চরিত্রে। এছাড়াও তালিকায় রয়েছে তপন সিনহা পরিচালিত 'হুতুমের নকশা'। অভিনয়ে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, নির্মল কুমার, মনোজ মিত্র।

নব্বইয়ের দশক
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আসতে থাকে 'রাজেশ্বরী' এবং 'মহাপ্রভু'। রানি রাসমণির জীবন নিয়ে তৈরি হয় 'রাজেশ্বরী' এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের উপর আধারিত 'মহাপ্রভু'। অন্যতম এই দুটি ধারাবাহিকের পরই ১৯৯৭ সালে শুরু হয় জন্মভূমি। ধারাবাহিকটি ২০০২ সাল পর্যন্ত সম্প্রচারিত হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সময়কার নতুন প্রজন্মের অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেকে। 

 

 

বিনোদনের স্বাদবদল
জোছন দস্তিদার, তপন সিনহা, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষের তৈরি করা রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে শুরু করল একদল পরিচালক এবং প্রযোজক। বিনোদনের স্বাদবদল ঘটতেই সংস্কৃতির উপর পড়ল কোপ। এর জন্য অবশ্যই একমাত্র দায়ী একতা কাপুর। তিনি নিজের হাতে হিন্দি টেলি জগতের ধ্বংস করে গিয়েছেন সাস-বহু ড্রামার উত্থাপন করে। হিন্দিতে কোরা কাগজ, সার্কাস, ফৌজি, মালগুড়ি ডেজ, তারা, দেখ ভাই দেখ, বনেগি আপনি বাত থেকে এক নিমেষে দর্শকমহলও খানিক নির্লজ্জের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল একতার সাস-বহু ড্রামায়। মাঝে যাও বা ঋতুপর্ণের 'গানের ওপারে' এল, তাও সাদরে বিদায় জানিয়ে দিল বাঙালি দর্শক। 'সত্য সেলুকাস বড় বিচিত্র এই দেশ (বাঙালি)।'

সংস্কৃতির উপর 'কোপ'
প্রজন্মের সঙ্গে অবশ্যই বদল ঘটবে স্বাদের। তবে সেই উপকরণ যে একেবারেই স্বাদের বাইরে চলে যাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। নতুন ধরণের দর্শকমহল তৈরি হতেই এল নতুন ধারাবাহিক। 'বউ কথা কও', 'এখানে আকাশ নীল'র মত বহু ধারাবাহিক ভিন্ন ধারার বিনোদন দেওয়ার কথা রেখে পরবর্তীকালে এনে ফেলে সেই নাটকীয়তা যা ক্রমশ ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়াল বাংলা ধারাবাহিকে। শাশুড়ি-বউমার সমস্যা অথবা বরের একাধিক বিয়ে। দুই বউ একই সঙ্গে থাকে এক বাড়িতে। গল্পের গরু গাছে ওঠে কেবল সকলের মুখে মুখে শোনাই যেত, এখন তা টিভি খুললে দেখাও যায় বইকি। 

 

 

শিশুদের উপর চরম মানসিক প্রভাব
'পটলকুমার গানওয়ালা', এখনকার অত্যন্ত জনপ্রিয় ধারাবাহিকের মধ্যে একটি। পটলকুমারের মত আরও একটি বাচ্চার চরিত্র ছিল। নাম ছিল তুলি। তার সংলাপ, অঙ্গভঙ্গি দেখলে কিংবা শুনলে যেকোনও সুস্থ মানুষ লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নেবে। ঠিক কেমন প্রযোজনা কিংবা পরিচালনার প্রয়োজন হতে পারে এই ধরণের সংলাপ লিখতে গেলে। তা আজও অজানা। এখন আর বিনোদন নয়, চলছে টিআরপি গেম।

 

 

টিআরপি-র খেলা 
বিনোদন বিয়োগ, টিআরপি-র যোগ। এটাই হল খেলার একমাত্র নিয়ম। তা সে যাই করতে হোক না। 'কে আপন কে পর'র জবাকে দিয়ে বম্ব ডিফিউজ করানো আবার তাকে দিয়েই ওকালতি করানো। সবই সম্ভব আর কি। একই বাড়িতে দুই বউকে বিয়ে করে রেখে দেওয়া। ক্রমাগত খলনায়িকার, নায়িকাকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা। সাধারণ পরিবারের এমনটাই কি দেখা যায় না তবে এমনটাই বিশ্বাস করেন দর্শকমহল।