সংক্ষিপ্ত
- সঞ্জীব কুমার একটি অন্যরকম অভিনেতা হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন
- বেঁচে থাকলে সঞ্জীব কুমারের বয়স হত আজ ৮২ বছর
- রুপোলি পর্দায় ট্র্যাজেডি কিং দিলীপ কুমার
- রুপোলি পর্দায় থেকেও বাস্তব জীবনের 'ট্র্যাজেডি কিং' হলেন সঞ্জীব কুমার
তপন বক্সী: বেঁচে থাকলে সঞ্জীব কুমারের বয়স হত আজ ৮২। ভারতের হিন্দি সিনেমায় সঞ্জীব কুমার একটি অন্যরকম অভিনয়ধারার অভিনেতা হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অথচ তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়ে গেলেন মেনস্ট্রিম হিন্দি সিনেমার বলয়ে। ঘুরিয়ে বলতে গেলে সঞ্জীবকে পেয়েছিল বলে ভারতের মূলস্রোত হিন্দি সিনেমার দর্শকও বাণিজ্যিক ছবি দেখতে এসে অন্য মহার্ঘ কিছুর স্বাদ নিয়ে ফিরে গিয়েছেন সিনেমাহল থেকে।
আরও পড়ুন-এ কী চেহারা, 'বেলুনের মতো ফুলে গিয়েছে শরীর', নোংরা কটাক্ষ শুভশ্রীকে, সপাট জবাব 'রাজ ঘরনি'র
আরও পড়ুন-অবিশ্বাস্য, তৃতীয়বার মা হতে চলেছেন করিনা কাপুর, নেটদুনিয়ায় সুখবর দিলেন নায়িকা নিজেই
সঞ্জীব কুমার খুব চড়া আলোর পাশে টেবিল্যাম্পের হালকা আলোর সার রিয়্যালিজম। পরাবাস্তব পাহাড়ের কোল থেকে উঠে আসা এক সাধারণ মানুষের ধুসর রূপকথা হয়ে ওঠার মত। তাই হিন্দি সিনেমার নির্মাতাদের সবাই নন। কেউ কেউ নিজেদের ছবি নির্মাণে লিখে ফেলা কোনও অন্তঃসলিলা পুরুষ চরিত্রের জন্য বান্দ্রার ওই লিফট ছাড়া পুরনো বাড়িটার তিন তলায় শতকষ্ট করেও উঠে আসতেন তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের দরজায়। সঞ্জীব যে ওই চরিত্রে কাজ করতে চাইবেন, ততদিনে বাছাই কিছু নির্মাতা বুঝে গিয়েছেন। তা নাহলে বাইশ বছর বয়সেই কেউ প্রৌঢের চরিত্রে বিনা দ্বিধায় কাজ করতে রাজি হতেন না। আর এরকম তিনি একবার করেন নি। অনেকবার করেছেন।
দিলীপ কুমার তাই নিজের কাছে আসা বেশকিছু অফারে রেফার করেছেন সঞ্জীবের নাম। হয়ত দিলীপ নিজে সেই রোল কোনও কারণে করবেন না। তখনই সাজেস্ট করেছেন সঞ্জীবের নাম। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সেরকমই একটি ছবির নাম। 'নয়া দিন নয়ি রাত'(১৯৭৪)। অফার ছিল দিলীপ কুমারের করার। করেছিলেন সঞ্জীব কুমার। বলিউডে সঞ্জীবের প্রতি দিলীপের এই স্নেহের প্রকাশের কথা প্রবীণ মানুষদের কাছে অনেকবার শুনেছি।
আর কি আশ্চর্য, বান্দ্রার সেই পালি হিলেই দুজন থাকতেন। একজন তো মাত্র গতকালই বর্তমান থেকে অতীত হলেন।দিলীপ কুমার সঞ্জীবের সঙ্গে প্রথম অভিনয় করেছিলেন 'সংঘর্ষ' ছবিতে (মহাশ্বেতা দেবীর বাংলা ছোট গল্প 'লায়লি আশমানের আয়না' নিয়ে তৈরি)। বান্দ্রার 'পালি হিল' তার আভিজাত্যের মর্যাদা পেয়েছে দিলীপ কুমারের জন্য। ১৯৪০-এর শেষের দিকে অথবা '৫০-এর শুরুর মুখে যখন দিলীপ তাঁর পরিবার নিয়ে ক্রফোর্ড মার্কেটের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে বান্দ্রায় খাটাও মিলসের জমি লিজে নিয়ে সেখানে বাংলো করেছিলেন। একই পাড়ায় সঞ্জীব থাকতেন 'পেরিন ভিলা'-য়।
দিলীপ নিজে মনে করতেন, তাঁর বিকল্প হতে পারেন সঞ্জীব কুমার। সেজন্য তিনি প্রযোজক সেই বিকল্পের কথা বলতেন। এহেন যে সঞ্জীব কুমার, তাঁকে জীবন থেকে চলে যেতে হয়েছে চরম মানসিক নিঃসঙ্গ অবস্থায়।
আসল নাম হরিভাই জরিওয়ালা। পরিবারে জরির ব্যবসা ছিল। তিন ভাই। এক বোন। বড় সঞ্জীব। মেজ কিশোর। তারপর বোন গায়ত্রী। এরপর ছোট ভাই নিকুল। পরিবারের সব পুরুষেরই হার্টের প্রবলেম। পঞ্চাশের বেশি কোনও পুরুষ বাঁচেন না।
সঞ্জীবই পরিবারে একমাত্র অডম্যান আউট। যিনি জরির ব্যবসায়ে না গিয়ে থিয়েটারের স্পটবয় থেকে প্রম্পটারের ভূমিকা হয়ে কোনও এক অভিনেতার অনুপস্থিতিতে অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন। যে অভিনেতা সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন, তাঁর বয়স ছিল ৬০। ষাট বছর বয়সের সেই অভিনেতার প্রক্সি দিতে হয়েছিল ২২ বছরের হরিভাইকে। তারপর থেকে তাঁর জীবনে তিনি কোনও প্রৌঢের চরিত্রে অস্বচ্ছন্দ বোধ করেন নি।
'হরিভাই জরিওয়ালা' নাম সিনেমার অভিনয়ের জন্য ঠিক ছিল না বলে 'হরিভাই' হয়ে উঠেছিলেন 'সঞ্জয় কুমার'। ১৯৬৭-তে প্রযোজক, পরিচালক শাওন কুমার টাক তাঁর 'ননিহাল' ছবিতে 'সঞ্জয়'-কে 'সঞ্জীব' করে দিলেন। কেননা সেই সময় সঞ্জয় খানের কোনও একটি ছবি সুপার হিট হয়েছিল। এভাবেই 'হরিভাই জরিওয়ালা' সঞ্জয় কুমার হয়ে শেষমেষ 'সঞ্জীব কুমার' হয়ে উঠলেন। সান্তাক্রুজের 'সেক্রেড হার্ট হাইস্কুল'-এর ফোর্থ স্ট্যান্ডার্ন্ডে উঠেই ছেড়ে দিয়ে গুজরাতি স্কুলে ভর্তি হতে হল। একটু উঁচু ক্লাসে উঠে গুজরাতি নাটকে। গুজরাতি নাটক থেকে গুজরাতি সিনেমায়। সেখান থেকে হিন্দি নাটকে। হরিভাইকে হিন্দি নাটকের পীঠস্থান 'গণনাট্য সংঘ'-এ ব্রেক দিয়েছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা ও নির্দেশক এ.কে.হাঙ্গল।
সঞ্জীব কুমারের ক্রাশ ছিলেন হেমা মালিনী। হেমাকে তিনি প্রোপোজও করেছিলেন। ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে সিরিয়াসলি ইনভলভ হওয়ার আগে হেমা সঞ্জীব কুমার আর জিতেন্দ্রর সঙ্গে সিরিয়াসলি প্রেম করেছেন। সঞ্জীবের সঙ্গে হেমার রিলেশনশিপ নিয়ে সঞ্জীবের ভাইপো উদয়ের সঙ্গে আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। সঞ্জীবের খুবই স্নেহের ভাইপো উদয়। উদয় সঞ্জীবের ছোট ভাই নিকুল জরিওয়ালার বড় ছেলে। উদয়ের ছোট ভাইয়ের নাম 'পৃথ্বী'। ভাইদের মধ্যে ছোট হলেও নিকুল জরিওয়ালা বিয়ে করেছিলেন সবার আগে। উদয় ছিল জরিওয়ালা পরিবারের এই প্রজন্মের প্রথম পুত্রসন্তান। তাই সবার প্রিয়। সঞ্জীব কুমার তাঁর এই ভাইপোকে নিজের ছেলের মতই বড় করেছিলেন।
সেই উদয়কেই জিজ্ঞেস করেছিলাম হেমাজির সঙ্গে সঞ্জীব কুমারের রিলেশনশিপ নিয়ে। উদয় ওঁর বড় জ্যাঠামশাই সঞ্জীব কুমারকে 'দাদা' বলতেন। উদয় বলেছিলেন, 'আমার ঠাকুরমা যে 'দাদা'-র সঙ্গে খুব অ্যাটাচড ছিলেন সেকথা টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক। ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর ঠাকুরমার কাছে বড় জ্যাঠামশাই-ই ছিলেন সবকিছু। কিন্তু আমার ঠাকুরমা হেমাজিকে বিয়ের পর ফিল্মে অভিনয় করতে দিতে আগ্রহী নন বলে যে কথা বাজারে গুঞ্জন আছে, তা সত্যি নয়। আমাদের পরিবারের পুরুষদের হার্টের প্রবলেমের জন্যই 'দাদা' বিয়েটা করতে চাননি। আপনাকে বলি, দাদার প্রথম অ্যাটাকটা হয় ১৯৭৬-এ। আমেরিকায় শো করতে গিয়ে। হিউস্টনে পিসি গায়ত্রীর বাড়িতে। এরপর ১৯৭৮-এ ঠাকুরমা মারা যান। দাদার সেকেন্ড অ্যাটাকটা হয় ১৯৮১ কিম্বা ১৯৮২-তে। প্রথম অ্যাটাকের পরেই দাদা ভেবেছিলেন বিয়ে করাটা ঠিক হবে না।'
হিন্দি সিনেমা জগতের অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা বলেন, 'সঞ্জীব কুমারের প্রথম অ্যাটাকের আগেই হেমা সঞ্জীবের জীবন থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর থেকে সঞ্জীব ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। মদ-ই হয়ে উঠেছিল ওঁর সব সময়ের সঙ্গী। সেকথা জানতেন সঞ্জীবের মা-ও। ১৯৭৮-এ মা মারা যাওয়ার পর সঞ্জীব কুমার ভেঙে পড়েন আরও। আরও আরও বেশি করে ডুবে থাকতে শুরু করেন মদের মধ্যে। হেমা তখন ধরমের সঙ্গে বাঁধা পড়ে গিয়েছেন।
জীবন কি সিনেমার মত হয়? হয়না। বরং সিনেমা-ই জীবনের মত হয়। এই যে সঞ্জীব কুমার, তাঁকেই সুলক্ষণা পন্ডিত পাগলের মত ভালবেসে সর্বস্ব ত্যাগ করে ঘর বাঁধতে চাইলেও প্রযোজকরা সুলক্ষণাকে প্রথমে নায়িকা হওয়ার পরামর্শ দেন।সুলক্ষণা ওঁর ২১ বছর বয়সে সঞ্জীব কুমারের নায়িকা হয়েছিলেন 'উলঝন' ছবিতে। সেই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই বেচারা ১৬ বছরের বড় সঞ্জীবের প্রেমে পড়েন। যে প্রেমের ঘেরাটোপ থেকে সুলক্ষণা আজও বেরতে পারেন নি। সঞ্জীবের তখন সুলক্ষণাকে বিয়ে করার মত মানসিকতাই ছিল না। সুলক্ষণা এখন সঙ্কটাপন্ন এক মানসিক রোগী। সারা জীবন অবিবাহিত থেকে ছোট বোন বিজয়েতার কাছে থাকেন। এ যেন, যশ চোপড়ার 'দিল তো পাগল হ্যায়' ছবির স্ট্রাকচারাল প্লট। সঞ্জীব চাইলেন হেমাকে। হেমা চলে গেলেন বিবাহিত, চার ছেলে মেয়ের বাবা ধরমের কাছে। আর ব্যাচেলর সঞ্জীব কুমারকে প্রাণপণ চেয়েও পেলেন না সুলক্ষণা।
ছবির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য তেমন তাড়া ছিল না সঞ্জীবের। বরং কোয়লিটি নিয়ে ভাবতেন। দিলীপ কুমারের মত। দিলীপের থেকে অনেক পরামর্শ পেয়েছেন। ওঁর অভিনীত কয়েকটি ছবির নাম বললেই বোঝা যাবে। 'সত্যকাম', 'খিলোনা', 'দস্তক', 'অনুভব'(বাসু ভট্টাচার্য), 'কোশিশ'(গুলজার), 'অনহোনি', 'মৌসম'(গুলজার),'আঁধি'(গুলজার), 'অনামিকা', 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি'(সত্যজিৎ রায়), 'শোলে', 'সিলসিলা' এরকম কিছু। হিন্দি ছবির রুপোলি পর্দায় দিলীপ কুমার যদি 'ট্র্যাজেডি কিং' হন, তাহলে রুপোলি পর্দায় থেকেও বাস্তব জীবনের 'ট্র্যাজেডি কিং' হলেন সঞ্জীব কুমার।