আজ ভারতে ৪টে এমন সংস্থা রয়েছে যারা ক্রেডিট স্কোর হিসাব করে। এদের বলা হয় ক্রেডিট ব্যুরো বা ক্রেডিট ইনফর্মেশন কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে CIBIL, CRIF High Mark, Equifax ও Experian-এর মতো সংস্থা।
লোন নিতে গেলে আমরা বেশিরভাগ সময়েই সুদের হার নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। কোন ব্যাঙ্ক কতটা সুদ নেবে, কতটা শর্ত চাপাবে, কতটাই বা ঝামেলা হবে—এই হিসেবেই শুরু হয় চিন্তা। কিন্তু এই হিসেবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটার কথা আমরা অনেকেই খেয়াল করি না।
সুদের হার ঠিক করে দেয় ব্যাঙ্ক নয়, বরং আপনার নিজের ব্যবহার করা কার্ড, খরচের প্যাটার্ন, আপনার আর্থিক শৃঙ্খলাবোধ। প্রতিদিনকার ছোট ছোট অর্থনৈতিক আচরণই গড়ে তোলে একটি সংখ্যা, আর সেই সংখ্যাই হয়ে ওঠে আপনার লোন পাওয়ার প্রধান মাপকাঠি। এই সংখ্যাটাই হল ক্রেডিট স্কোর।
আজ ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় ক্রেডিট স্কোর এমন এক পরিচয়পত্র, যা ছাড়া ব্যাঙ্ক আপনাকে বিশ্বাস করতে চায় না। কখনও আপনার হাতে ক্রেডিট কার্ড আছে, কখনও আপনি পার্সোনাল লোন নিয়েছেন, হয়তো কিছু EMI এখনো চলছে—এসবের একসঙ্গে হিসেব করে চারটি সংস্থা আপনার আর্থিক চরিত্র তৈরি করে। CIBIL, CRIF High Mark, Equifax আর Experian—এই চার ব্যুরোই নির্ধারণ করে দেখে আপনার অতীতে কোনও ভুল ছিল কি না, আপনি সময়মতো বিল মিটিয়েছেন কি না, লিমিটের কতটা খরচ করেছেন, কোনও লোনে সমস্যায় পড়েছেন কি না। সব মিলিয়ে প্রস্তুত হয় ৩০০ থেকে ৯০০-এর মধ্যে একটি নম্বর।
এই নম্বরই শেষ পর্যন্ত বলে দেয় ব্যাঙ্কের চোখে আপনি কতটা ‘বিশ্বাসযোগ্য’। স্কোর যদি ৭৫০-এর ওপরে হয়, ব্যাঙ্ক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কম সুদে, কম ঝামেলায়, দ্রুত অনুমোদনে লোন মেলে। এমনকি প্রিমিয়াম ক্রেডিট কার্ড, ট্র্যাভেল সুবিধা, বিভিন্ন বীমা ও রিওয়ার্ডস—সবই সহজ হয়ে ওঠে। কারণ উচ্চ স্কোর ব্যাঙ্ককে আশ্বস্ত করে—এই গ্রাহক ঝুঁকিপূর্ণ নন, তাঁর কাছে টাকা দেওয়া সুরক্ষিত।
কিন্তু স্কোর যদি মাঝামাঝি থাকে, ব্যাঙ্ক তখন নিজের ভাবনাচিন্তা বদলে ফেলে। অতীতে কোথাও না কোথাও আপনাকে নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বুঝে নেয় তারা। লোন পাওয়া তখনও সম্ভব, কিন্তু সুদের হার বাড়তে থাকে, সঙ্গে বাড়ে শর্ত ও যাচাই–বাছাই। আর যদি স্কোর ৬৫০-এর নিচে নেমে যায়, তখন ব্যাঙ্ক আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না। এমন স্কোর ব্যাঙ্ককে স্পষ্ট বলে দেয়—আপনার মধ্যে খেলাপির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে লোন হয় মুশকিল, সুদের হার হয় যন্ত্রণাদায়ক।
সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল—বেশিরভাগ মানুষ নিজেই বুঝতে পারেন না কীভাবে যে স্কোর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো কোনও মাসে পুরো বিল না দিয়ে শুধুই ‘মিনিমাম ডিউ’ দিয়েছেন, হয়তো মোট লিমিটের বেশিরভাগটাই খরচ করে ফেলেছেন, হয়তো একসঙ্গে বিভিন্ন লোন ও কার্ডের জন্য আবেদন করেছেন। এই ছোট ছোট ভুলগুলোই জমতে জমতে স্কোরকে টেনে নামায়। অথচ সময়মতো সব বিল মিটিয়ে দেওয়া, আয় অনুযায়ী খরচ রাখা এবং প্রয়োজন ছাড়া নতুন লোনের খোঁজ না করা—এসব সহজ অভ্যাসেই স্কোর স্থির থাকে, বরং ধীরে ধীরে বাড়তেও থাকে।
লোনের সুদের হার এমনই একটি বিষয়, যেখানে ব্যাঙ্ক যতটা গুরুত্ব রাখে, তার থেকে বেশি গুরুত্ব রাখেন আপনি নিজেই। কারণ ব্যাঙ্ক শুধু আপনার অতীত আচরণকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়; সেই আচরণ গড়ে ওঠে আপনার প্রতিটি swipe, প্রতিটি EMI, প্রতিটি বিল পেমেন্ট দিয়ে। আপনার আর্থিক শৃঙ্খলা যেদিন উন্নত হয়, সেদিনই কমে যায় আপনার ভবিষ্যতের সুদের বোঝা।
একটা উচ্চ ক্রেডিট স্কোর শুধু লোন পাওয়ার চাবিকাঠি নয়—এটা আসলে আর্থিক স্বাধীনতার পথ। আপনি যদি নিজের স্কোরকে যত্ন করেন, ব্যাঙ্ক আপনার প্রতি ভরসা রাখবে। আর সেই ভরসারই ফল—কম সুদে লোন, দ্রুত অনুমোদন, এবং আর্থিক সিদ্ধান্তে স্বস্তি। অর্থাৎ লোনের সুদ আপনি ঠিক করেন না—আপনার প্রতিদিনকার অভ্যাসগুলোই ঠিক করে দেয় কতটা মূল্য আপনাকে দিতে হবে ভবিষ্যতে।


