সংক্ষিপ্ত
মিলিয়ন ডলার ক্রিকেট। আইপিএল (IPL)-এর আবির্ভাবে এই তকমাটা লেগে গিয়েছিল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই টি-২০ (T20) ধামাকা ক্রিকেট। জনপ্রিয়তা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এর আয়ের উৎস। যার মোটা মুনাফা ঢুকেছে ক্রিকেটারদের পকেটেও।
২০২২ আইপিএল (IPL 2022) -এর ২ দিনের নিলামে মোট ১০টি দলের বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৫১.৭ কোটি টাকা। যা দিয়ে মোট ২০৪ জন ক্রিকেটারকে কিনেছে আইপিএল (IPL)-এর দলগুলি। এরমধ্যে ৬৪ জন বিদেশি ক্রিকেটারও রয়েছে। এবারের আইপিএল-এ সবচেয়ে দামি বিদেশি ক্রিকেটারের তকমা গিয়েছে লিয়াম লিভিংস্টোন (Liam Livingstone)-এর দখলে। তাঁকে ১১.৫ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে পঞ্জাব কিংস (Punjab Kings)। আবার আনক্যাপড প্লেয়ারের তালিকা থেকে সবচেয়ে দামি বিদেশি ক্রিকেটারের তকমা পেয়েছেন আভেশ খান (Avesh Khan)। তাঁকে ১০কোটি টাকা দিয়ে কিনেছে লখনউ সুপার জায়ান্ট (Lucknow Super Giant)।
এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার তালিকায় আইপিএল প্রথম চারের মধ্যে রয়েছে। যার সম্মিলিত ভ্যালুয়েশনের অঙ্কটা ৬বিলিয়ন ডলারকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। বলতে গেলে ক্রিকেটারদের কাছে আইপিএল যেন একটা জ্যাকপট। এখানে একবার খেলার সুযোগ পেলেই কোটিপতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত বলেই মনে করেন ক্রিকেটাররা। এমনকী, ক্রিকেটের উন্মাদনার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ আয়ের এই বিশাল ক্রিকেট প্রতিযোগিতা বিদেশি ক্রিকেটারদের কাছেও আইপিএল-এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছে। এর সঙ্গে অবশ্যই আইপিএল গ্ল্যামারের সঙ্গে আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে থাকা গ্ল্যামার-পার্টি-সুন্দরীদের ভিড়, যা এই টি-২০ লিগের মাদকতাকে ক্রিকেটারদের মধ্যে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বছরের পর বছর।
এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক বিদেশে হওয়া টি-২০ লিগ এবং আইপিএল-এর টাকার অঙ্কের ফারাকটা কেমন--
অঙ্ক বলছে অন্যান্য দেশে আইপিএল-এর ঢঙে যে ক্রিকেট প্রতিযোগিতাগুলো হয় সেখানে অর্থ বিনিয়োগের পরিমাণটা অনেক কম। যার ফলে আইপিএল-এ খেলা ক্রিকেটারদের আয় অন্তত ১০০ শতাংশ বেশি। এমনকী কোন কোনও ক্রিকেটার তো বছরের পর বছর তাদের আয়ের বহর বাড়িয়ে ২০০ শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। বলতে গেলে আইপিএল এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে অর্থ বলশালী ক্রিকেট প্রতিযোগিতা।
গ্লোবাল স্পোর্টস-এর একটি সমীক্ষা বলছে ২০১৮ সালে আইপিএল খেলা ক্রিকেটাররা গড়ে প্রতি ম্যাচে ২.৭৮ কোটি টাকা করে আয় করেছেন। অন্যদিকে আমেরিকার ন্যাশনাল ফুটবল লিগ বা এনএফএল খেলা ফুটবলাররা ১৬টি ম্যাচ ১.৪০ কোটি টাকা আয়য় করেছিলেন। এমনকী ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বা ইপিএল-এর ফুটবলাররা ৩৮ গেমে প্রতিটি ম্যাচে গড়ে ৭৯ লক্ষ টাকা করে আয় করেছিলেন। যদিও, ইপিএল প্রতি বছর মোট ৬০টি করে ম্যাচ হয়। সেখানে প্লেয়ারদের আয় আরও দ্বিগুণ হয়। কিন্তু এটা প্রথম ৩৮টি গেমের প্রতিটি ম্যাচের হিসাব।
পরিসংখ্যান বলছে আইপিএল-এর ১১তম সিজনে বিনিয়োগের বহর ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যার ফলে মোট বিনিয়োগ ৬.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল সেই বছর। তবে অতিমারির কারণে এই মুহূর্তে আইপিএল-এর মোট ভ্যালুয়েশন ৪ বিলিয়ন ডলারের সামান্য কিছু বেশি। তবে, এই টাকার অঙ্কটাও বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে চলা যে কোনও ক্রিকেট প্রতিযোগিতা এবং টি-২০ প্রতিযোগিতার থেকে অনেকটাই বেশি। এর জন্য অবশ্যই বিসিসিআই-এর একটা বড় অবদান রয়েছে। কারণ, বিসিসিআই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ধনি ক্রিকেট বোর্ড। যার মোট ভ্যালুয়েশন এই মুহূর্তে ১৮,০১১.৮৪ কোটি টাকা।
এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক যে আইপিএল খেলা কোন বিদেশির আয়ের বহরটা কেমন-
ডি আর্চি শর্ট- বিগ ব্যাশ টি-২০ ক্রিকেট লিগে এই অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডারের দল হল হোবার্ট হ্যারিকেনস। এই প্রতিযোগিতায় শর্টের মোট আয় হল ২ কোটি টাকা এবং তিনি প্রতিযোগিতার সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার। অথচ, আইপিএল-এ রাজস্থান রয়্যালস-এর হয়ে খেলেই শর্ট আয় করতে চলেছেন ৪কোটি টাকা।
রশিদ খান- আফগানিস্তানের এই লেগ স্পিনার বিশ্ব ক্রিকেটে একটা সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। এমনকী টি-২০ ক্রিকেটের যে কোনও প্রতিযোগিতায় যে কোনও দলের কাছে অটোমেটিক চয়েস। পাকিস্তান সুপার লিগ লাহোর কোয়ালান্ডার্স-এর হয়ে খেলে রশিদ খান আয় করেছেন ৯৭ লক্ষ টাকা থেকে ১.২ কোটি টাকা। আর রশিদ-ই নাকি এই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার। এছাড়াও ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার টি-২০ লিগে বার্বাডোজ রয়্যালস-এর হয়ে খেলে রশিদ আয় করেছেন ৮৩ লক্ষ টাকা। টি-২০ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা বিবিএল-এ অ্যাডেলেইড স্ট্রাইকার্সের খেলে তাঁর আয় ১৪.৭ কোটি টাকা। সেখানে আইপিএল খেলেই রশিদ আয় করেন ১৫ কোটি টাকা।
ফাফ ডুপ্লেসি- বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই টি-২০ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় দেখা যায় ডুপ্লেসি-কে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বা বিপিএল-এ ক্যামেলিয়া ভিক্টোরিয়ানস-এর হয়ে খেলে ডুপ্লেসি-র আয় ৯৩ লক্ষ টাকা থেকে ১.২ কোটি টাকা। পাকিস্তান সুপার লিগ বা পিএসএল-এর হয়ে খেলে তাঁর আয় ৯৭ লক্ষ টাকা থেকে ২ কোটি টাকা। কিন্তু আইপিএল খেলে ডুপ্লেসির আয় ৭ কোটি টাকা।
মহম্মদ নবি- আফগানিস্তানের এই অলরাউন্ডার টি-২০ ক্রিকেট লিগে একটা পরিচিত নাম। পাকিস্তান সুপার লিগ বা পিএসএল-এ করাচি কিংস-এর হয়ে খেলে ৪৪ লক্ষ টাকা আয় করেছেন নবি। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা সিপিএল-এর আয়ের পরিমাণ তাঁর ক্ষেত্রে ৯৭ লক্ষ টাকা। সেখানে আইপিএল-এ কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলে নবির আয় ১ কোটি টাকা।
ক্রিস গেল- টি-২০ ক্রিকেট লিগে-এর দুনিয়ায় গেল-কে ইউনিভার্স বস নামে ডাকা হয়। আইপিএল-এর অন্যতম দামি ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম গেল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ খেলে গেল আয় করেছেন ৭৪ লক্ষ টাকা। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলে তাঁর আয় ১.১৯ কোটি টাকা। সেখানে গত আইপিএল-এ পঞ্জাব কিংস-এর হয়ে খেলে তাঁর আয় ২ কোটি টাকা। যদিও, আইপিএল-এর একটা সিজনে এখন পর্যন্ত গেল-এর সর্বোচ্চ আয় ৮.৪ কোটি টাকা।
কেন আইপিএল-এর বিশাল অঙ্কের অর্থ আয়ের সুযোগ--
দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইপিএল দলগুলির অংশিদারদের নিজস্ব কোনও ব্যবসা রয়েছে। আইপিএল এই বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার ব্র্যান্ড ইকুইটি এবং সেলস প্রোমোশনেও সাহায্য করে। এবার সেখান থেকে পাওয়া বাড়তি অর্থ এই অংশিদাররা আইপিএল-এ বিনিয়োগ করেন নতুন করে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে আইপিএল যেমন একটা অর্থশীল বাজার হিসাবে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক তেমনি বিনিয়োগের পর বাড়তি মুনাফা অর্জন অংশিদারদের সদিচ্ছাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত আইপিএল-এ বিনিয়োগের বহর বাড়ছে।
আইপিএল-এর দলগুলির মালিকদের কাছে অর্থ আয়ের আরও একটি বড় উৎস হল এনডোর্সমেন্ট। বিভিন্ন প্রোডাক্টের সঙ্গে গাটছাড়া বেঁধে খেলার মাধ্যমে বিজ্ঞাপণের মুনাফা অর্জনও করছেন এই মালিকরা। প্লেয়ারদের জার্সি থেকে প্যাড, কিট, অফ ফিল্ড পোশাক, ট্র্যাক কোর্ট, ট্র্যাক প্যান্ট, গাড়ি- সবেতেই এনডোর্সমেন্টের বহর লেগেই থাকে। যা আইপিএল মালিকদের কাছে অর্থ আয়ের আরও একটি বড় উৎস।
এতো গেল আইপিএল দলগুলির কথা। আয়োজক সংস্থা বিসিসিআই আইপিএল-এর সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি করেও মোটা মুনাফা অর্জন করে। এই মুহূর্তে স্টার স্পোর্টসের কাছে সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি করেছে বিসিসিআই। যেখান থেকে মোট ১৬,৭৪০ কোটি টাকা আয় করছে তারা।
আরও পড়ুনঃকোন সাংবাদিক হুমকি দিয়েছিলেন, অবশেষে তার পরিচয় প্রসঙ্গে মুখ খুললেন ঋদ্ধিমান সাহা
আরও পড়ুনঃকোহলিকে সোনার বুট উপহার দিয়ে আবেগপ্রবণ চিঠি যুবরাজের, পড়লে চোখের কোণ ভিজবে আপনারও
আরও পড়ুনঃআইপিএলের হরভজন-শ্রীসন্থের চর কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি পিএসএলে, দেখুন ভাইরাল ভিডিও
এর বাইরেও আইপিএল ট্রফি-র এনডোর্সমেন্ট এবং প্রতিযোগিতার সম্মিলিত এনডোর্সমেন্ট-ও বিসিসিআই-এর হাতে। সেখান থেকেও অর্থ আয় করছে তারা। এর একটা ভাগ প্রতিটি আইপিএল দলের কাছেও যায়। টাটা গ্রুপ এবার আইপিএল-এর টাইটেল স্পনসর। যার এনডোর্সমেন্ট মূল্য ৬৭০ কোটি টাকা। এছাড়াও রয়েছে পেটিএম। যাদের কাছ থেকে বিসিসিআই পাচ্ছে ৩২৬.৮০ কোটি টাকা। এর বাইরেও বিসিসিআই আইপিএল-এর দলগুলির মালিকদের কাছ থেকে ১০ বছরের রেজিস্ট্রেশন ফি নেয়। যা ইনস্টলমেন্টে প্রতিটি দলকেই চুকাতে হয়। তবে, বিসিসিআই-এর মোট মুনাফার একটা কিয়দংশ আইপিএল দলগুলির কাছে যায়।
উপরের আলোচনা এবং তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিস্কার যে আইপিএল ক্রিকেটারদেরকে সবচেয়ে বেশি অর্থ আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। এই প্রতিযোগিতা থেকে ক্রিকেটাররা অনেক বেশি অর্থ আয়ের সুযোগ পান। আর সেই কারণেই আইপিএল এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ধনি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। এই কারণেই বিদেশি ক্রিকেটাররাও আইপিএল-এর শরিক হতে চান।