সংক্ষিপ্ত

মহালয়ার ভোরে কাকে দেখলেন বিশ্বনাথ?  বললেন- 'আমার ছেলেরাও জানে, তার বাবা-কাকা মেয়েদের কোনও দিন অশ্রদ্ধা করেননি। সে কথা বড় ছেলে সবাইকে জানিয়েওছে। ‘আমার দুর্গা’দের আশীর্বাদে এটুকুই আমার অহঙ্কার।'

হাসির মোড়কে সংবেদনশীল মনটাকে সযত্নে মুড়ে রাখেন বিশ্বনাথ বসু। সেখানে  ‘আমার দুর্গা'-দের বসতি। কখনও উৎসব উপলক্ষে তাঁদের মুখে অন্ন তুলে  দেন। চুপিচুপি কখনও হাতে গুঁজে দেন দিন চালানোর উপকরণ। মহালয়ায় এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে সে কথা প্রথম জানালেন অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু। 
   
মহালয়ার ভোরেই আমার দুর্গার দেখা পেলাম। হাওড়ায় আমার শ্বশুরবাড়ি। সেখানকার গঙ্গার ঘাটে তর্পণ করি। পুজোপাঠ সেরে ঘাটে উঠতেই দেখে গুটিসুটি এক ‘মা’ বসে রয়েছেন। জরাজীর্ণ শরীরে শতছিন্ন শাড়ি। নিজেকে বয়ে নিয়ে চলার শক্তি নেই। ঘোলাটে চোখে যেন শেষ পাড়ানির কড়ি খুঁজছে। অনেকটা থানার এক পাশে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা সাইকেলের মতো। হয়ত তার থেকেও খারাপ অবস্থা। কে জানি অবহেলায় ফেলে রেখে গিয়েছে তাঁকে। এ ভাবে মহালয়ার ভোরে দেবীর দেখা পাব, ভাবতেও পারিনি। 

দর্শন যখন দিলেনই তখন তো তাঁর নৈবেদ্যও প্রাপ্য। সাধারণত, কাউকে কিছু দিয়ে সেটা নিয়ে বড়াই করি না। এতে যিনি দিচ্ছেন এবং যিনি নিচ্ছেন— উভয়েই খাটো হয়ে যান। আজ জানাচ্ছি। কারণ, আমার দুর্গাকে আমার মতো করে আরাধনা করে তৃপ্ত। পকেটে সামান্য যা ছিল তাঁর হাতে গুঁজে দিলাম সবার অলক্ষ্যে। অস্ফুটে বললাম, ‘মা বাকি দিনগুলোও তো চলতে হবে। তোমার ছেলে তাই তোমায় সামান্য কিছু দিয়ে গেল। ঝটপট আঁচলে বাঁধো। সামলে রেখো।’ আমার কথা তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ। আমি বাড়ির পথ ধরলাম।  

আসলে, ‘আমার দুর্গা’ বিষয়টা এতই স্পর্শকাতর, কী যে বলি! কাকে ছেড়ে কার কথাই বা বলি? বাংলার ঘরে ঘরে ‘আমার দুর্গা’রা ছড়ানো। আমাদের চোখ নেই। তাই দেখেও দেখি না। আমিও তাই কোনও এক জনের কথা বলব না। আমার তালিকাটাও বেশ বড়। প্রথমেই বলব আমার দেশের বাড়ির দেবী দুর্গার কথা। ওই মুখ, ওই হাসি, ওই চাউনি— তুলনা নেই। বাড়ির পুজোর ফাঁকে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখি। পুজো উদ্বোধনের সময়েও নানা থিমের দেবী মা দেখার সুযোগ হয়ে যায়। কিন্তু আমার বাড়ির মা-এর মতো মুখ আজও অন্য প্রতিমার আদলে খুঁজে পেলাম না। 

আর ‘আমার দুর্গা’রা পথে পথে কাটান। সবাই তাঁদের ফুটপাথবাসিনী বলেন। পথেই সংসার, পথেই দশভূজা তাঁরা। গাড়িতে বসে দেখি, দুই হাতে রান্নার পাশাপাশি সন্তান আগলাচ্ছেন। পরিপাটি করে স্বামীকে হয়ত ভাত বেড়ে দিচ্ছেন। রাতে পথের এক ধারে আরামের শয্যা পাতছেন। কী ভাবে চলে এঁদের? কেউ খোঁজ নেয় না। আর কিছু দুর্গা আসেন পুজোর সময়। আমার দেশের বাড়িতে। পুজো, প্রতিমা দেখতে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে আসেন। প্রতিমা দর্শন শেষে ভোগের আশায়। আজ পর্যন্ত তাঁরা অভুক্ত থাকেননি। আমি, আমার ভাই মিলে তাঁদের যত্ন করে খাওয়াই। তাঁরা তৃপ্ত হয়ে আশীর্বাদ করতে করতে ফিরে যান। 

আমার ছেলেরাও জানে, তার বাবা-কাকা মেয়েদের কোনও দিন অশ্রদ্ধা করেননি, করবেনও না। সে কথা বড় ছেলে সোচ্চারে সবাইকে জানিয়েওছে। ‘আমার দুর্গা’দের আশীর্বাদে এটুকুই আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার। 
অনুলিখন- উপালি মুখোপাধ্যায়, একান্ত সাক্ষাৎকার সংগ্রাহক প্রতিনিধি- উপালি মুখোপাধ্যায় 
আরও পড়ুুন- 
'৬ বছর বয়সে ৬ মাসের বোনকে প্রথম দুধ গুলে খাইয়েছি, এখন সে আমায় সামলায়!'- সৌরভ 
'কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাবা-কাকার মৃত্যু! একার দায়িত্বে সংসার ধরে রেখেছিলেন মা'- শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 
'যাঁদের জন্য কোণঠাসা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ! আপনারা না থাকলে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না'- শ্রীলেখা মিত্র