সংক্ষিপ্ত

'ওকে জড়িয়ে কী নোংরামি, কুৎসা। লজ্জায়, ঘেণ্ণায় নিজেকে সবার থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। সে দিনও পাশে দাঁড়িয়েছিল আমার ছোট বোন।'আমার দুর্গা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এমনই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন সৌরভ। নিজের কলমে লিখলেন তাঁর জীবনের আমার দুর্গার কাহিনি। 
 

সৌরভ দাস। ব্যতিক্রমী অভিনেতা। ‘মণ্টু পাইলট’ বা ‘চরিত্রহীন’-এ প্রচণ্ড সাহসী। ‘কলকাতা চলন্তিকা’ ছবিতে একদম ভিন্ন। তাঁর চোখে  ‘আমার দুর্গা’ও তাই গতে বাঁধা কেউ নন। কে সৌরভের এই বিশেষ মানুষ? জানল এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। 

আমার বোন তখন খুব ছোট, খুবই। বড় জোর মাস ছ’য়েক। মা-বাবা দু’জনেই চাকরি করেন। সারা দিন পরিশ্রমের পরে মা আবার বাজারে যেতেন। সে দিনও গিয়েছিলেন। কোনও কারণে মায়ের ফিরতে দেরি হচ্ছিল। এ দিকে বোনের খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। সেও অবুঝ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। প্রথমে ফুঁপিয়ে। তার পরে গলা ফাটিয়ে। কিছুতেই সামলাতে পারি না! বাড়িতেও আর কেউ নেই। সে দিন বড় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। 

বরাবরই সবার সব কাজ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা আমার অভ্যাস। মাকে দেখতাম, কী করে বোনের দুধ তৈরি করে খাওয়াত। সেই ছবিটা মনে করে জল গরম করে, বোতলে গুঁড়ো দুধ আর গরম জল মিশিয়ে ভাল করে ঝাঁকিয়ে, হাতের পাতায় বোতল উপুড় করে দেখে নিয়েছিলাম। গরমটা সহ্য করার মতো কিনা। ঠিক মায়ের মতো করেই। তার পর বোনের মুখের কাছে ধরেছিলাম। বোন নিজেই ফিডিং বোতল ধরতে পারত। আমি চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। ভাবছি, নির্ঘাৎ ডাহা ফেল। নিশ্চয়ই আরও জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠবে।  

কোথায় কী! বোন দেখি কান্না থামিয়ে দিব্যি দুধ খাচ্ছে। আনন্দের চোটে সারা বাড়িজুড়ে নেচে বেড়িয়েছিলাম সেই সন্ধেয়। একা একাই। আমি তা হলে পেরেছি! বোনের দায়িত্ব নিতে শিখে গিয়েছি। আমি, এই সৌরভ দাস তখন মাত্র ছয় বছরে। সেই শুরু। বোনকে সারাক্ষণ আগলে বেড়ানো। আমার থেকে অনেকটাই ছোট বোন। কিন্তু আমার যেন সন্তানসম। অজান্তেই ওর বাবা হয়ে বসেছি। ওর ভাল-মন্দের দায় অলিখিত ভাবেই যেন আমার। বোনও ধীরে ধীরে দাদার উপরে নির্ভর করতে লাগল। স্কুল-কলেজের দুষ্টুমি, প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেমিক— মাকে নয়, আমায় বলত। অথচ পড়াশোনায়, স্বভাবে আমরা বিপরীত।

সেই বোন যত বড় হয়েছে ততই পড়াশোনায় সেরা। নিজের শহরে পড়া শেষ করে বাইরের থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। সেখানে ওর কত আদর-কদর! সবার অনুরোধ, ‘তুমি থেকে যাও। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াও।’ বোন এখন বেঙ্গালুরুতে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াচ্ছে। পাশাপাশি, আমার অজান্তে আমার আরও এক ‘মা’ হয়ে উঠেছে। নিজে পড়ছে। দরকারে মায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসার চালাচ্ছে। আমি যখন কোনও কারণে ভেঙে পড়ি তখন আমায় জড়িয়ে ধরে আগলাচ্ছে। বুদ্ধি-পরামর্শও দিচ্ছে। এক নারী একা হাতে এত কিছু করছে হাসিমুখে। আপনারাই বলুন, সে ‘আমার দুর্গা’ ছাড়া আর কী? 

সুযোগ পেলেই আমি ‘আমার দুর্গা’কে আমি নানা ভাবে সাজাই। কখনও সালোয়ার-কুর্তা-জিন্সে। কখনও শাড়িতে। যদিও যে কোনও নারী শাড়িতেই সুন্দরী। আমার বোনও। তাই এ বারের পুজোতেও ওকে কয়েকটি শাড়ি দিয়েছি। বোনও কী সুন্দর নিজেকে সাজাতে শিখেছে! আমার ছবির প্রিমিয়ারে ছিমছাম সাজে পরি হয়ে আসে। চোখ ফেরাতে পারি না। মনে হয়, এই তো সে দিন প্রথম ওকে নিজের হাতে খাইয়েছিলাম। সেই মেয়েটা এত সুন্দর সাজতেও শিখে গেল!  

অথচ ওকে জড়িয়েই কী নোংরামি, কুৎসা। লজ্জায়, ঘেণ্ণায় নিজেকে সহার থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে বেরোতে চাইতাম না। সে দিনও পাশে দাঁড়িয়েছিল আমার ছোট বোন। বড় আদরের। ভীষণ গর্বের। চোখে জল দেখলেই নানা কথায় ভুলিয়ে দিত। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমার অজান্তেই ‘আমার দুর্গা’ কত বড় হয়ে গেল! 
অনুলিখন- উপালি মুখোপাধ্যায়, একান্ত সাক্ষাৎকার সংগ্রাহক প্রতিনিধি- উপালি মুখোপাধ্যায় 
আরও পড়ুন- 

'কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাবা-কাকার মৃত্যু! একার দায়িত্বে সংসার ধরে রেখেছিলেন মা'- শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 
'শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই মুখ ফিরিয়েছিলেন, এখন সবাইকে ডেকে বলেন, নন্দিনী তো আমাদেরই বৌমা!' 
'যাঁদের জন্য কোণঠাসা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ! আপনারা না থাকলে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না'- শ্রীলেখা মিত্র