সংক্ষিপ্ত
- নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর কোনও বিকল্প ছিল না
- বরাবরই সহানুভূতিশীল এবং ভদ্র প্রেমিকের ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে
- বলিউডের প্রথম চকোলেট বয় বলা হয় ঋষি কাপুরকে
- নায়িকাপ্রধান ছবিতে অভিনয় করেছেন অম্লানবদনে
ইরফান খানের মৃত্যু সংবাদ এখনও হজম করে উঠতে পারেনি গোটা দেশ। এর মধ্যেই আরও এক ইন্দ্রপতন। আরও এক উজ্জ্বল তারকাকে হারাল ভারতীয় চলচ্চিত্র জগত। মুম্বইয়ের স্যার এইচ এন রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতীয় সিনেমার চকোলেট বয় ঋষি কাপুর।
সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঋষিকাপুরের কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি ভারতীয় সিনেমা নয়। মারকুটে, প্রতিবাদী নায়ক নয় বরং সহানুভূতিশীল এবং ভদ্র প্রেমিকের ভূমিকায় বারবার তাঁকে দেখে এসেছেন দর্শকরা। নায়িকা প্রধান ছবিতে অভিনয় করতে সাধারণত প্রতিষ্ঠিত নায়কদের মধ্যে কিছুটা অনীহা কাজ করে। বিশেষ করে বলিউডের পুরুষ তারকাদের মধ্যে এই প্রবণতা রয়েছে জোরালো ভাবেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শীর্ষেও কখনও এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাননি ঋষি কাপুর। ‘ববি’, ‘চাঁদনি’, ‘নাগিনা’, ‘হেনা’, ‘সাহেবান’, ‘দামিনী’র মতো নারীপ্রধান সিনেমায় অভিনয় করেছেন অম্লানবদনে।
ঋষি কাপুরের জন্ম ১৯৫২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, মুম্বাইতে, বিখ্যাত কাপুর পরিবারে। রাজ কাপুরের মেজ ছেলে তিনি, ডাক নাম চিন্টু। ১৯৭০ সালে বাবা রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম পর্দায় আসেন। ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। সে কারণে প্রচুর ঋণ জমে যায় রাজ কাপুরের। ব্যবসায়িক ক্ষতি সামলাতে তিনি নতুন ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। মুম্বাইয়ে সফল বাণিজ্যিক ছবি তৈরির অব্যর্থ ফর্মুলা হলো প্রেম। সে সময় বলিউডের সুপার স্টার রাজেশ খান্না ছিলেন প্রেমের ছবির একচেটিয়া নায়ক। কিন্তু রাজ কাপুরের তখন বেশ টানাটানি চলছে। রাজেশ খান্নাকে ছবিতে নেওয়া মানেই বিপুল অর্থ ব্যয়। রাজ কাপুর তাই ভাবলেন আনকোড়া নতুন মুখ নিয়ে টিনএজ প্রেমের ছবি বানাবেন। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে নায়িকা নেওয়া হলো পনের বছর বয়সী ডিম্পল কাপাডিয়াকে। শত শত মেয়ের মধ্য থেকে তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এমন প্রচার চালানো হলো। সব ফিল্মি পত্রিকার প্রচ্ছদে তখন ববিরূপী ডিম্পলের ছবি। ছবির নায়ক হিসেবে রাজ কাপুর নিলেন নিজের ছেলে ঋষিকে। এভাবেই নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু হলো ঋষি কাপুরের।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ‘ববি’। সুপার ডুপার হিট ‘ববি’র কল্যাণে ‘চকলেট হিরো’র তকমা জোটে ঋষির। সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান। এরপর টিনএজ প্রেমের ছবি মানেই ঋষি কাপুর, এমন একটি ধারা শুরু হয়। ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ৯২টি ছবিতে প্রেমিক নায়কের ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। অবশ্য পরে অভিনয় প্রতিভায় এই ইমেজকে অতিক্রম করেছেন তিনি। ‘খোঁজ’, ‘তাওয়ায়েফ’, ‘প্রেমরোগ’, 'কর্জ', ‘হেনা’র মতো ছবি দিয়ে ঋষি কাপুর প্রমাণ করেছিলেন তিনি কাপুর পরিবারের অন্যতম সেরা অভিনেতা।
প্রায় ৫১টি ছবিতে একক নায়ক এবং ৪২টি ছবিতে যুগ্ম নায়ক হয়েছেন ঋষি। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অনেক ছবিতে দেখা গেছে তাঁকে। ‘কাভি-কাভি’, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘নসিব’, ‘কুলি’র মতো হিট ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তার অভিনয় দর্শকদের মন জয় করে। শ্রীদেবীর সঙ্গে তার জুটিও ছিল দর্শকপ্রিয়। ‘বানজারান’, ‘চাঁদনি’, ‘নাগিনা’ ছবিতে দুজনের পর্দা-রসায়ন ছিল চমৎকার।
আরও পড়ুন: ১৪ বছরের নীতুকে দেখলেই খুনসুটি শুরু করতেন ঋষি, বিয়ের দিন জ্ঞান হারিয়েছিলেন মিয়া-বিবি
মাধুরী দিক্ষিতের বিপরীতে ‘সাহেবান’, ‘প্রেমগ্রন্থ’, জুহি চাওলার বিপরীতে ‘বোল রাধা বোল’, ডিম্পল কাপাডিয়ার বিপরীতে ‘ববি’, ‘সাগর’, দিব্যা ভারতীর বিপরীতে ‘দিওয়ানা’, পদ্মিনী কোলাপুরীর বিপরীতে ‘প্রেম রোগ’ তার ‘ভদ্র প্রেমিকে’র ইমেজকে প্রতিষ্ঠিত করে।
ঋষি কাপুর অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘হাম কিসিসে কম নেহি’, ‘দুসরা আদমি’, ‘ফুল খিলে হায় গুলশান গুলশান’, ‘বদলতে রিশতে’, ‘সারগাম’, ‘দো প্রেমী’, ‘কর্জ’, ‘ইয়ে ওয়াদা রাহা’, ‘বাড়ে দিলওয়ালা’, ‘হাওয়ালাত’, ‘ঘর ঘর কি কাহানি’, ‘আজাদ দেশ কি গুলাম’, ‘আমিরি গরিবি’। ‘খোঁজ’ ছবিতে নেতিবাচক চরিত্রে তার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত।
নতুন শতকে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন ঋষি কাপুর। ‘ইয়ে হ্যায় জালওয়া’, ‘তেহজিব’, ‘হামতুম’, ‘ফানা’, ‘নামাস্তে লন্ডন’, ‘লাভ আজকাল’, ‘পাতিয়ালা হাউজ’, ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ ছবিতে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে প্রশংসিত হন তিনি। ‘অগ্নিপথ’ ছবির রিমেইকে খলচরিত্রে তার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। ‘বেশরম’ ছবিতে ছেলে রানবির কাপুরের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন তিনি। ব্রিটিশ ছবি ‘ডোন্ট স্টপ ড্রিমিং’এবং ‘সামবার সালসা’তে অভিনয় করেন। এক সাক্ষাৎকারে ঋষি কাপুর বলেন, নায়ক চরিত্র থেকে পার্শ্ব-চরিত্রে সরে যাওয়ার পর দারুণ স্বস্তি বোধ করেন তিনি। কারণ নায়ক না হওয়ায় মুটিয়ে যাওয়ার দুঃশ্চিন্তা থেকে তিনি রেহাই পান।
শুধু কাপুর পরিবারের রত্নই নন, বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতাও ঋষিকাপুর। ৬৭ বছরে তাঁর এই চলে যাওয়া বলিউডের আকাশে নতুন করে কালো মেঘ নিয়ে এল।