সংক্ষিপ্ত
পান্নালালের আত্মহত্যায় ধনঞ্জয় শোকে পাগল! তীব্র অভিমান নিয়ে গানে গানে কারণও জানতে চেয়েছিলেন-- 'থির হয়ে তুই বস দেখি মা দুটো কথা কই/ আজ আছি মা শান্ত হয়ে কাল যদি না রই'!
সাল, তারিখের হিসেব বলছে, ৫৬ বছর তিনি নেই। তবু কালীপুজোর দিন তিনি ভীষণভাবে জীবন্ত। বাংলা ছবির গায়ক হিসেবে জীবন শুরু। কেন সেই গান ছেড়ে শ্যামাসঙ্গীত আঁকড়ে ধরেছিলেন? মাঝেমধ্যেই শ্মশানে যেতেন কিসের খোঁজে? তাঁর জীবনেও ঘটেছে বহু অলৌকিক ঘটনা। তবু দেবী কালীকার দেখা পাননি কোন ভুলে? মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কী কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন 'ঘোরতর সংসারী' পান্নালাল ভট্টাচার্য?
আমার সাধ না মিটিল....
রেকর্ড বা রেডিয়োর গান নয়, অনলাইনে সিঙ্গলস শোনার যুগ। পাড়ার পুজোয় বা বিয়েবাড়িতে ইউটিউবে গান বাজে। তার পরেও প্রতি বছর কালীপুজো এলেই পান্নালাল ভট্টাচার্য ফিরে ফিরে আসেন। তাঁর সেই আকুতি মাখানো ‘মা’ ডাক না শুনলে বাঙালি যেন তৃপ্তি পায় না। যুগের পর যুগ কেটেছে। পান্নালাল যেন বহুমূল্য রত্ন পান্নার মতোই উজ্জ্বল। তাঁকে কালজয়ী করার পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি? শিল্পীর প্রবাদপ্রতিম দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ছেলে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একাধিক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার জন্য তাঁর কাকা আজও অমর।
স্বর্ণযুগের স্বনামধন্য শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। পান্নালালের খুব ইচ্ছে, দাদার মতো তিনিও ছায়াছবির নেপথ্য গায়ক হবেন। আধুনিক গান গাইবেন। সেই মতো মেগাফোন কোম্পানিতে দুটো গানও রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু তখন বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগে রাজত্ব করছেন শচীন দেব বর্মন, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র। এ দিকে পাঁচের দশকের পর ভক্তিগীতিতে নতুন শিল্পীর প্রয়োজন। যিনি কে মল্লিক, ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষের যোগ্য উত্তরসূরী হবেন। দীপঙ্করের মতে, পান্নালালের মধ্যে ভক্তিরসের সেই জোয়ার ছিল। আর ধনঞ্জয় ছিলেন জহুরি। তাই রত্ন চিনে তাঁর সঠিক স্থান বলে দিতে পেরেছিলেন। নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানিতে। বলেছিলেন, ‘‘আজ থেকে এখানে ভক্তিগীতির দায়িত্ব দিন পান্নাকে। ও কোম্পানির মুখ রাখবে।’’ ভাই তাঁর মেজদাকে বেদবাক্য মানতেন। তাই আধুনিক, ছায়াছবির গান ভুলে অনায়াসে গেয়েছিলেন শ্যামাসঙ্গীত। ধনঞ্জয় যে কতখানি সঠিক তার প্রমাণ, আজও কালীপুজো এলে, শ্যামাসঙ্গীতের কথা উঠলে পান্নালাল ভট্টাচার্যের নাম সবার ঠোঁটে।
চাই না মাগো রাজা হতে...
ভট্টাচার্য পরিবার বরাবরের শাক্ত। ধনঞ্জয়-পান্নালালের ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন পুরোহিত। ফলে, আজন্ম তাঁদের শরীরে ভক্তিরসের ধারা। মোট ১১ জন ভাই-বোনের মধ্যে সবথেকে ছোট শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী। তিনি যখন সাত মাসের, মায়ের গর্ভে তখনই তাঁর বাবা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়। ধনঞ্জয় তাই নিজের হাতে মানুষ করেছিলেন, গড়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাইকে। দাদা তাই পান্নালালের কাছে বাবার সমান। দাদাকে তাই সারা ক্ষণ নাকি নকল করতেন তিনি। তাঁর মতো করে হাঁটা-চলা-কথা বলা তো ছিলই। হাতের লেখা পর্যন্ত নকল করার চেষ্টা করতেন! এই করতে করতেই পান্নালালের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, তাঁর দাদা সেরা ভক্তিগীতি গাইয়ে। শ্যামাসঙ্গীত গাইলে তাঁর মতো করে গাইতে হবে!
ওই কারণেই কোনও অনুষ্ঠানে গেলে ধনঞ্জয়ের আগে গান গেয়ে উঠে আসতেন পান্নালাল। তাঁর দাবি, মেজদা থাকলে তিনি গাইতে পারবেন না। ধনঞ্জয়েরও ভাইকে নিয়ে কিন্তু প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল। তিনি বলতেন, অসংখ্য ‘‘শ্যামাসঙ্গীত গাওয়ার পরেও পান্নার মতো আমি ওরকম নাড়ি ছেঁড়া ‘মা’ ডাক ডাকতে পারলাম কই?’’ একবার বিখ্যাত ভক্তিগীতি গায়ক কে মল্লিকের পাড়ার অনুষ্ঠানে ধনঞ্জয় একঝাঁক শিল্পী নিয়ে গিয়েছেন গান গাইতে। হঠাৎ ধবধবে সাদা চুল-দাড়ির এক বৃদ্ধ এসে সেই দলের মধ্যে কাকে যেন খুঁজছেন। তিনিই বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী কে মল্লিক। সবাই তাঁকে প্রশ্ন করছেন, কাকে খুঁজছেন তিনি? উত্তরে সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, পান্নালালকে। কাকাকে তখন তাঁর সামনে দাঁড় করাতেই কে মল্লিক নাকি জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘‘এমন ভাবে কী করে গান গাস তুই? কী করে এমন করে মাকে ডাকতে পারিস?’’ সেদিন সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখেছিলেন, এক সাধক-গায়ক কী ভাবে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীকে চোখের জলে বরণ করে নিচ্ছেন।
তুই বড় না মুই...
এই জায়গা থেকেই ধীরে ধীরে পান্নালালের মনে অসন্তোষ তৈরি হতে থাকে। কিছুতেই নিজেকে নিয়ে, নিজের গান নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি। তার উপরে প্রচুর শ্যামাসঙ্গীত না গেয়েও ধনঞ্জয়ের দেবীদর্শন হয়েছে। স্বপ্নে মা ভবতারিণী এসে বলেছিলেন, ‘‘তোর হাতে মাছ খাব!’’ ধনঞ্জয় খাইয়েছিলেন। পান্নালালও যে দেবীকে উপলব্ধি করতে পারতেন না তা নয়। কিন্তু তাঁর মেজদার মতো কোনও দিন মাতৃদর্শন হয়নি।
এক বার অনুষ্ঠান সেরে শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে ফিরছেন। হঠাৎই বালি স্টেশনের একটু পান্নালালের মুখ লাল। চোখে জল। আপন মনে বলে উঠেছিলেন, মাকে তুঁতে বেনারসি পরানো হয়েছে! কেউ বিশ্বাস করেননি। শেষে শিল্পীর দাবি, নেমে দেখে এলেই তো হয়! তাঁর কথায় হইহই করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষের মতো শিল্পীরা। মন্দিরে গিয়ে দেখলেন, সত্যিই মা ভবতারিণী তুঁতে রঙের বেনারসি পরে সেজেছেন! সবাই সে দিন মুখ চাওয়াচায়ি করেছিলেন। শিল্পীর পরিবারের মতে, সঠিক আধার না থাকায়, আদর্শ গুরু না পাওয়ায় দেবীর এই কৃপা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। প্রতি কালীপুজোয় মেজদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে অনুষ্ঠান করার পর সেখানেই সারা রাত কাটাতেন তিনি। তবু কোনও দিন মাকে দেখতে পাননি!
আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই...
যত দিন গিয়েছে এই তৃষ্ণা পান্নালালের আরও বেড়েছে। তাঁর একটাই যন্ত্রণা, মেজদাও শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছেন। তিনিও গান। তা হলে মা কেন মেজদার কাছে আসেন, তাঁর কাছে নয়! আস্তে আস্তে ঘোরতর সংসারী পান্নালাল সংসারের বন্ধন ছিঁড়েছেন। প্রায়ই গিয়ে শ্মশানে বসে থাকতেন। আর শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে মাকে ডাকতেন। তাঁকে একবার দেখার জন্য শিল্পীর সেই আকুতি গান হয়ে ঝরেছে। একটা সময় নিজের হাতে তাঁর মেয়েদের চুল বেঁধে দিতেন পান্নালাল। দারুণ রাঁধতেন। স্ত্রীকে নিজে পছন্দ করে শাড়ি এনে দিতেন। সেই তিনিই আস্তে আস্তে সংসার থেকে সরতে আরম্ভ করলেন। মাকে পেতেই হবে, এই লক্ষ্য নিয়ে। যেন মা না আসলে তিনিই যাবেন মায়ের কাছে।
অভিশপ্ত ১৯৬৬ সাল। ওই বছরেই ধনঞ্জয়ের সুরে পান্নালালের রেকর্ড, 'অপার সংসার নাহি পারাপার'। আর ওই বছরেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, দেবী দর্শনের অতৃপ্তি নিয়ে নিজেকে শেষ করে দেন শিল্পী! ভাইকে অকালে হারিয়ে সন্তান হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছিলেন ধনঞ্জয়। তাঁর হাহাকার বেজেছে তাঁরই লেখা দুটো গানে--- 'ত্রিভুবন জয় করিয়া রাবণ আনিল রত্নরাজি/ গড়েছিল তার স্বপ্ন রাজ্য পান্না যে তার নাম', 'থির হয়ে তুই বস দেখি মা দুটো কথা কই/ আজ আছি মা শান্ত হয়ে কাল যদি না রই'!