সংক্ষিপ্ত
ছেলেবেলা থেকেই ছেলেটি ছিল খাদ্যরসিক। পকেটে পয়সা থাকলেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে খেতে যেতেন, সেই মানুষটিই নয় দিন অভুক্ত থেকেও তাঁর সামনে পড়ে থাকা তাঁর পছন্দের খাবারগুলির দিকে তাকিয়ে শুধু একবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ দাস (Jatindranath Das), লোকমুখে 'যতীন দাস' (Jatin Das) বাবা ডাকতেন 'খেঁদু' বলে। রাজবন্দিদের মর্যাদার দাবিতে যতীন দাস লাহোর জেলে ১৯২৯ সালে অনশন শুরু করেছিলেন ভগৎ সিং (Bhagat Singh), বটুকেশ্বর দত্তদের সঙ্গে। ইংরেজ সরকার (Britist Government) কিছুটা নমনীয় হলে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত অনশন তুলে নেন। কিন্তু একরোখা যতীন দাস তা করেন নি। একটানা ৬৩ দিন অনশন (Hunger Strike) চালিয়েছিলেন। পরে নল দিয়ে জোর করে খাওয়ানোর সময় শ্বাসনালিতে খাবার আটকে লাহোর জেলে যতীন দাসের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। লাহোর থেকে শবদেহ কলকাতায় এলে সুভাষচন্দ্র বসু নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন খাটের একদিক।দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের শবদেহ বহনের পর দ্বিতীয় আর কোনো বিপ্লবীর শবদেহ নিয়ে জনবিস্ফোরণ ঘটল কলকাতার বুকে। যতীন দাসের শোকযাত্রায় প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিল সেদিন। শহীদ যতীন দাসের আত্মবলিদানের এক অজানা কাহিনি শোনাচ্ছেন অনিরুদ্ধ সরকার।
ছেলেবেলা থেকেই ছেলেটি ছিল খাদ্যরসিক। পকেটে পয়সা থাকলেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে খেতে যেতেন, সেই মানুষটিই নয় দিন অভুক্ত থেকেও তাঁর সামনে পড়ে থাকা তাঁর পছন্দের খাবারগুলির দিকে তাকিয়ে শুধু একবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন। একটি দানাও মুখে তোলেননি।জেল সুপার তাঁর ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকে কিছু বুঝিয়ে-সুজিয়ে খাওয়ানোর জন্যে। কিন্তু তাঁর অদম্য জেদ, তাঁর ইচ্ছা শক্তি, আর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কাছে সবাই হার মানল। এইভাবেই চলেছিল তাঁর আমৃত্যু অনশন। আর একদিন অনশনেই মৃত্যু হল তাঁর।
ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে যে বোমা ছুঁড়েছিলেন সেগুলি ছিল যতীন দাসের বানানো। যতীন দাস সেকারণে গ্রেপ্তার হন। রাজবন্দিদের মর্যাদার দাবিতে লাহোর জেলে ১৯২৯ সালে অনশন শুরু করেন ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত এবং অন্যান্য বিপ্লবীরা। যতীন দাসও সেই অনশনে যোগ দেন। পরে ইংরেজ সরকার কিছুটা নমনীয় হলে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্তরা অনশন তুলে নেন। কিন্তু একরোখা যতীন দাস তা করলেন না। তিনি অনশন চালিয়ে গেলেন।
ব্রিটিশ পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও যতীনকে খাওয়াতে পারল না। তখন নল দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। অসম্ভব যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালো যতীন। ৪৮ ঘন্টা ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর, জ্ঞান ফিরল যতীনের। চোখ খুলতেই তিনি দেখলেন তাঁকে প্রলুব্ধ করার জন্য তাঁর সেলে নানা ধরনের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি তাঁর পছন্দের খাবারগুলির দিকে একবার তাকালেন আর তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন।
যতীনের মুখ দিয়ে তখন মাঝেমাঝে রক্ত উঠছে। যতীনকে খাওয়ানোর চেষ্টা করার সময় নলটি জোরপুর্বক খাদ্যনালী থেকে শ্বাসনালীতে ঢুকে যাওয়ায় তাঁর গলার শিরা ছিঁড়ে যায়। যতীনের গলা দিয়ে তখন আর কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। ভগৎ সিং যতীনের কাছে এলেন। তিনি বুঝতে পারলেন সারাজীবন যতীন আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না।ভগতের চোখে জল।
আস্তে আস্তে যতীনের শরীর ভেঙে পড়ছে। অনশনের ফলে শরীরে আর শক্তি নেই। তারসঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের অকথ্য নির্যাতন। যতীন ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে পক্ষাঘাত তাঁর শরীরকে গ্রাস করে ফেলছে। জেলার যতীনের শারিরীক অবস্থা দেখে ভয় পেলেন। জেলের ডাক্তার জানালেন, যেদিন ওই পক্ষাঘাত হৃদযন্ত্র স্পর্শ করবে সেদিন যতীনের মৃত্যু অনিবার্য। ভয় পেয়ে জেলার তাঁকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে রাজী হলেন কিন্ত বেঁকে বসলেন পঞ্জাবের গভর্নর মোরেন্সী।
পরের দিন জেল সুপার ডাক্তার ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে যতীনের সেলে ঢুকলেন। তখন তাঁকে ঘিরে ব্যারিকেড করে ঘিরে রয়েছেন ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। জেলের ডাক্তার বললেন – “কোনোভাবেই উনাকে উত্তেজিত করা যাবেনা, তাহলেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাবে।” জেল সুপার বুঝলেন আর কিছু করা যাবে না অপেক্ষা ছাড়া। ১৩ সেপ্টেম্বর। দুপুর ১টা ০৫ । চোখ বুজলেন যতীন দাস। মাত্র ২৪ বছর বয়সে চির নিদ্রায় ঢলে পড়লেন বাংলার এই বীর যোদ্ধা।১৩ই জুলাই থেকে ইংরেজ বিরোধী যে অনশনের শুরুবাদ ১৩ই সেপ্টেম্বর ৬৩ দিনের মাথায় হল তার চির সমাপ্তি।
তৎকালীন ভাইসরয়ের অফিস থেকে লন্ডনে বার্তা গেল, “ষড়যন্ত্র মামলার মিস্টার দাস, পাঁচজনের মধ্যে যিনি অনশন করছিলেন, আজ দুপুর বেলা ১টার সময় মারা গেছেন।”
রক্ত গোলাপের স্তুপে ঢেকে দেওয়া হল যতীন দাসের নশ্বর দেহ। রাজবন্দীরাই দেহ বহন করে নিয়ে গেলেন জেল গেট পর্যন্ত। তখন বাইরে পঞ্জবের নেতৃবৃন্দ অপেক্ষা করছেন। তাদের সঙ্গে অপেক্ষায় বিপুল জনতা। প্রতিটি মানুষের চোখে জল। শহীদকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন সবাই। বিকেল চারটে নাগাদ যতীনের দেহকে বহন করে এক শোভাযাত্রা বের হল শহরের পথে। প্রায় একলাখ লোকের একমাইল দীর্ঘ বিশাল শোক মিছিল। যা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ব্রিটিশ সরকার।
যতীন দাসের দেহ নিয়ে ’লাহোর এক্সপ্রেস’ বিকেলে দিল্লি পৌছল। দিল্লিতে যতীন দাসকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপচে পড়ল ভিড়। ফুল আর ফুলের মালা দিয়ে আগত অগনিত মানুষের মুখে ধ্বনিত হল, ‘ যতীন দাস জিন্দাবাদ যতীন দাস অমর রহে"। বিপ্লবীরা বলে চলেছেন 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'।দিল্লি থেকে রাত আড়াইটে নাগাদ ট্রেন কানপুর পৌছোল। সেখানেও বিপুল জনতা শ্রদ্ধা জানালো বিপ্লবী যতীন দাসকে। কানপুরের নেতৃবৃন্দ’রাও যতীন দাসের দেহের সামনে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।
তারপর শহীদ যতীন দাসের দেহ পৌঁছল বাংলায়। হাওড়া স্টেশনে তখন ভিড় উপচে পড়েছে। জনস্রোত প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে নিচের ইয়ার্ড অবধি পৌঁছে গেছে। স্টেশনে তিল ধারনের জায়গা নেই। স্টেশনের কাছে স্বেচ্ছা সেবকদের দ্বারা ঘেরা একটি জায়গায় খালি পায়ে অপেক্ষা করছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমস্ত কর্মসূচি বাতিল করে স্টেশন পৌঁছেছেন। সুভাষ বসুর সাথে উপস্থিত হয়েছেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী। যতীনের দেহ স্টেশন থেকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল টাউন হলে। সেখানে শ্রদ্ধা জানালেন যতীনের পিতা বঙ্কিমবিহারী দাস। তিনি বললেন, “আমার সন্তানের জন্য আমি গর্বিত। আমি আজ সবচেয়ে ভাগ্যবান পিতা।”
সেখান থেকে যতীন দাসের শবদেহ নিয়ে বিরাট মিছিল চলল কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে।সুভাষচন্দ্র বসু নিজের কাঁধে তুলে নিলেন খাটের একদিক। শহীদ যতীন দাসের শবদেহ বহন করে যে বিরাট জনতার সেই মিছিল চলেছে কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে। চারপাশে তখন ধ্বনিত হচ্ছে, "যতীন দাস জিন্দাবাদ, যতীন দা অমর রহে।"
সরকারি রিপোর্ট বলছে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের শবদেহ বহনের সময় জনবিস্ফোরণ ঘটেছিল। আর তারপর যতীন দাসের শবদেহ নিয়ে এই ব্যাপক জনসমাগম ঘটল কলকাতার বুকে। সরকারী রিপোর্ট অনুসারে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক সমবেত হয়েছিল সেদিনের সেই শোক মিছিলে।
Bypoll: দেবতা 'পাথারো'র অনুমোদন দেননি, তাই ওঁরা ৩০ অক্টোবর উপনির্বাচনে ভোট দেবেন না
Pegasus Case: কেন্দ্রের অস্বচ্ছতায় অসন্তুষ্ট সুপ্রিম কোর্ট, ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি তৈরি
একে একে শ্মশানে এসে দাঁড়ালেন বিশিষ্ঠ নেতৃবর্গ। নতুন করে আবার ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়া হল যতীনের দেহ। শঙ্খধ্বনি ও বিউগলের সঙ্গীত বেজে উঠলো। নতজানু হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু শহীদ যতীনদাসের পদধূলি নিয়ে নিজের কপালে নিলেন। প্রণাম জানালেন উপস্থিত বিপ্লবী ও নেতারা। চন্দনকাঠের চিতার ওপর যতীনের দেহ তোলা হল। পিতা বঙ্কিম বিহারী দাসের বাণী পাঠ করলেন হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত –
”ওঁ নারায়ণ! যে বিশ্বাসঘাতকতায় মগ্ন হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, তারই প্রায়চিত্ত স্বরূপ আমি আমার আদরের পুত্রকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। অশ্রুজল ভিজিয়ে আমার খেঁদুকে তোমার পায়ে সমর্পণ করলাম। তার এই আত্মবিনাশের মধ্য দিয়ে সমগ্র ভারত যেন জেগে ওঠে।”
যতীন দাসের মৃত্যুর পর প্রবাসী’-তে লেখা হয়েছিল, “তেষট্টি দিন ধরিয়া যতীন দাস মৃত্যুকে ধীর পদক্ষেপে ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে দেখিয়াছেন। কিন্তু ভীত, বিচলিত হন নাই। ধন্য তাঁহার দৃঢ়তা।” ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লেখা হল, “অনশনে জলমাত্র পান না করিয়া তেষট্টি দিন ধরিয়া মৃত্যুর আবাহন! তিনি অমৃতস্য পুত্রাঃ।” সুভাষ বসু বললেন, "যতীন হলো এযুগের দধীচী… অত্যাচারী ইংরেজ সরকারকে পরাজিত করবার জন্য নিজের অস্থি দিয়ে গেল। ১৫ই সেপ্টেম্বরকে আমি ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য ডাক দিচ্ছি।"
তথ্য ঋণ:
১| The Martyr: Bhagat Singh Experiments in Revolution, Kuldip Nayar
২| জেলে ত্রিশ বছর - ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।
৩| মৃত্যুর চেয়ে বড়- শৈলেশ দে।
৪| শহীদ যতীন দাস ও ভারতের বিপ্লব আন্দোলন- সন্তোষ কুমার অধিকারী।
৫| বিপ্লবী যতীন দাস- শেখ রফিক ও মিফতাহুর রহমান চৌধুরী।