সংক্ষিপ্ত
করোনাভাইরাস- গত ২ বছর ধরে মানব সভ্যতাকে এক্কেবারে কোণঠাসা করে দিয়েছে এই ভাইরাস সংক্রমণ। যার জেরে গত ২ বছরে সরকারি হিসাবে কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসেবটা তো মেলালে এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে। কাজ হারিয়েছেন অন্তত কয়েক কোটি মানুষ। বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার প্রবলভাবে চেপে বসেছে ১০০টিরও বেশি দেশে। কিন্তু, যে ভাইরাস নিয়ে বিধ্বস্ত মানব সভ্যতা, তার শিকড়ের গল্পটা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে মানুষ মনে রাখতে পেরেছে। করোনাভাইরাসের সেই ভয়ঙ্কর কাহিনি- আরও একবার আপনাদের জন্য।
করোনাভাইরাস আদতে কি? (What is Coronavirus?) -- করোনাভাইরাস হল আদতে এক ধরনের ভাইরাসের পরিবার। যার সংক্রমণে আক্রান্ত হয় মানুষ এবং পশু ও পাখি। এখন পর্যন্ত মানুষের শরীর থেকে সাত ধরনের করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। যার মধ্যে নাম রয়েছে- সার্স (SARS), মার্স (MERS) এবং কোভিড ১৯ (COVID 19)-এর মতো অতিমারির। তবে, এই করোনাভাইরাস পরিবারের মধ্যে কোভিড ১৯ যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দ্রুত স্বরূপ বদলাতে সক্ষম তা প্রমাণিত হয়েছে। যার জন্য কোভিড ১৯-এর মধ্যেও গত ২ বছরে ধরা পড়েছে একাধিক ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ। যার মধ্যে রয়েছে আলফা (Alpha), বিটা (BETA), গামা (GAMMA), ডেল্টা (DELTA), ওমিক্রন (OMICRON) এবং সম্প্রতি সামনে আসা এক্সই (XE), যাকে ভাইরোলজিস্টরা বলছেন ওমিক্রন-এর সাব-ভ্যারিয়েন্টস বিএ.১ (BA.1) এবং বিএ.২ (BA.2)-এর মিলিত রূপ।
কত ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে (what Types of Coronaviruses do exits?)
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
করোনাভাইরাস হল এমন এক ধরনের ভাইরাস সংক্রমিত রোগ যা মানুষ এবং পশু-পাখির ফুঁসফুঁস (Respiratory) এবং অন্ত্রে-এ সংক্রমণ (Intestinal Illness)ঘটায়। প্রথম দিকে এটি একটা হালকা সর্দি-কাশির (Mild Colds in People) মতো করে শরীরকে আক্রমণ করে। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে ফুঁসফুঁসের পক্ষে গুরুতর রেসপিরেটরি সমস্যা তৈরি করে। এর ফলে ফুঁসফুঁস-এর রক্তসঞ্চালনা ক্ষমতা কমে আসে এবং অক্সিজেনের মাত্রা রক্তে কমতে শুরু করে। যা অনেক সময় প্রাণঘাতি বলেও বিবেচিত হয়। একে সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (Severe Acute Respiratory syndrome) বা সার্স (SARS)বলেও অবিহিত করা হয়। ২০০২-০৩ সালে চিনে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে নজরে এসেছিল। ২০১২ সালে আরব দুনিয়াতেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব দেখা গিয়েছিল। যাকে ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাসে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (Middle East Severe Acute Respiratory syndrome) বা মার্স (MERS) নামে পরিচিত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চিনে প্রথম কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ পরিলক্ষিত হয়েছিল। এর কয়েক মাসের মধ্যেই তা বিশ্বকে গ্রাস করে এবং অতিমারির রূপ নেয়। চিনে যখন প্রথম এর প্রাদুর্ভাব হয় তখন এই ভাইরাসের চরিত্র বিচার করে একে সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস ২ (Severe Acute Respiratory syndrome Coronavirus 2) বা সার্স-কোভ ২-এর (SARS_CoV-2) অধীনে ফেলা হয়। এই ভাইরাসই বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলা কোভিড ১৯-এর মূল জন্মদাতা। চিনের উহান শহরে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল। এই শহরের মানুষ রাতারাতি নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে থাকেন এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের মৃত্যু হতে শুরু করেছিল।
করোনাভাইরাস দেখতে কেমন (What Do Coronavirus Look Like?)
--------------------------------------------------------------------------------------------
এক অতি সাধারণ গঠনতন্ত্র প্রক্রিয়ায় (একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকে করোনাভাইরাস। যা দেখতে অনেকটা স্পেরিক্যাল-এর (Spherical) মতো। আর এই ভাইরাসগুলোর চারপাশে একাধিক ছোট স্পাইক থাকে (Protein Spikes), যা এই ভাইরাসগুলোকে মানুষের শরীরের প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। কারণ ওই স্পাইকের মধ্যে দিয়ে ত্বকের মধ্যে ফুঁটো তৈরি করে শরীরে ঢুকে পড়ে করোনাভাইরাস। এই স্পাইকগুলোকে বলা হয় প্রোটিন স্পাইক (Protein Spikes)। এই প্রোটিন স্পাইক ভাইরাসের সেলগুলির একদম উপরের অংশে থাকায় তা দিয়ে খুব সহজেই শরীরকে সংক্রমিত করতে পারে।
আবার বর্তমানে যে করোনাভাইরাসের টিকা বের হয়েছে তাতে প্রচুর সাহায্য করেছে এই প্রোটিন স্পাইক। কারণ মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে এই প্রোটিন স্পাইকের মধ্যে দিয়ে ভাইরাসের গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করতে সমর্থন হয়েছেন বলেও দাবি করেছিলেন ভাইরোলজিস্টরা। যখন শক্তিশালী কোনও মাইক্রোস্কোপের নিচে করোনাভাইরাসকে দেখা যাবে, তখন এর প্রোটিন স্পাইকগুলোকে অনেকটা রাজমুকুটের মতো দেখতে লাগে। এই প্রোটিন স্পাইকের নিচে থাকে ভাইরাসের মেমব্রেন (Virus Membrane)। খার জাতীয় সাবান এবং অ্যাসকোহলে সংস্পর্শে এলে এই মেমব্রেন বেঁচে থাকতে পারে না। এর জন্য কোভিড ১৯ সংক্রমণের মধ্যে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া থেকে শুরু করে অ্যালকোহল মিশ্রিত স্যানিটাইজার ব্যবহার করার কথা বারবার বলে এসেছিলেন ভাইরোলজিস্টরা।
ভাইরাসের মেমব্রেন-এর মধ্যে থাকে জেনেটিক গঠন। যা জেনোম (Genome)বলে পরিচিত। চিকেনপক্স বা স্মলপক্সের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এদের জেনম মানুষের শরীরের মধ্যে ডিএনএ-র মতো করে গঠিত। কিন্তু করোনাভাইরাসের জেনোম তৈরি হয় আরএনএ ভাইরাস দিয়ে। আরএনএ ভাইরাসের জেনোম আবার খুব ছোট হয় এবং সমানে নিজের রূপ বদলাতে থাকে। যার জন্য এর গঠনতন্ত্রকে মাথায় রেখে এক্কেবারে ১০০ শতাংশ ফলদায়ক টিকা বানানো এই মুহূর্তে সম্ভব হয়নি।
আরএনএ ভাইরাসের এই জেনোমের সমানে রূপ পরিবর্তন মিউটেশন নামে পরিচিত। এই মিউটেশন ভাইরাসকে নতুন কৌশলে সংক্রমণ ঘটাতে সাহায্য করে। একটা সময় মনে করা হয়েছিল যে কোভিড ১৯ ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে বাদুড়ের শরীর থেকে। সেখানে ভাইরাস এত দ্রুত মিউটেশন করেছে যে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করার মতো করে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। তবে, এই যুক্তিতে এখনও সরকারিভাবে কোনও সিলমোহর পড়েনি।
কোভিড ১৯ আক্রমণ অন্য করোনাভাইরাসদের থেকে কেন বেশি শক্তিশালী (Why COVID 19 is more Powerfull than other Coronavirus?)
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭টি হিউম্যান করোনাভাইরাস বা এইসিওভিএস পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ৪টির সংক্রমণের লক্ষণ একই রকম। এগুলির সংক্রমণ খুব একটা
শক্তিশালী নয় এবং রেসপিরেটরি সমস্যায় এক্কেবারে প্রাণঘাতী নয়। যদিও, সর্দিকাশি-র সমস্যায় ভোগা কেউ এদের সংক্রমণে এলে জীবনের ঝুঁকি বাড়়িয়ে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। এমনকী প্রাণঘাতী বলেও প্রতিপন্ন হয় এই সময়।
এই করোনাভাইরাসগুলির বাইরে আর যে তিনটি করোনাভাইরাস রয়েছে সেগুলি সংক্রমণের দিকে মারাত্মকরকমের বিপজ্জনক। এই করোনাভাইরাসগুলির মধ্যে রয়েছে মার্স, সার্স এবং কোভিড ১৯।
কোভিড ১৯-এর করণীয় এবং অকরণীয় বিষয় (Dos and Don'ts in COVID 19)
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ আবার নতুন করে বাড়ছে। স্বাস্থ্য় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ভারতবর্ষে জুন মাসে চতুর্থ ওয়েভ আছড়ে পড়তে পারে। কিন্তু, এরমধ্যে আবার ভারত সরকার কোভিড ১৯ অতিমারির জেরে জারি করা সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। একই পদক্ষেপ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও। এহেন পরিস্থিতিতে নিজের সুরক্ষার ভার নিজেকেই নিতে হবে। কোভিড ১৯-এর যে বিধিগুলো গত দুই বছরে পালন করে এসেছেন তার অধিকাংশটাই অনুসরণ করার চেষ্টা করুন। বাইরে বের হলে মাস্ক পরুন। সমানে স্যানিটাইজারে হাত ধুয়ে নিন। অপরিচিতদের থেকে একটা মিনিমাম দূরত্ব মেপে চলুন। কোনও ভিড় বা বদ্ধ অডিটোরিয়াম-এ যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। আর গেলেও উপযুক্ত সুরক্ষা কবচ ব্যবহার করুন। সর্দি এবং মাথা ধরা থাকলে পারলে ভেপার নিন এবং বাইরে বেশি করে বের হতে গেলে গার্গল করুন বিটাডেন দিয়ে। দিনে অন্তত ৩ থেকে ৪বার। সাধারণ পরিবহণ এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো। তবে, উপযুক্ত সুরক্ষা নিয়ে তাতে যাতায়াত করতে পারেন। বাড়িতে উপযুক্ত স্যানিটেশন ব্যবহার করুন। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে হাতের কাছে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে রাখুন। কোভিড ১৯-এর দুটো টিকার পরে বুস্টার ডোজ না হলে তা নিয়ে রাখুন।
আরও পড়ুন- ভূতের শহর সাংহাই, লকডাউনের ভিডিওগুলি দেখলে চমকে যাবেন আপনিও
আরও পড়ুন- বিশ্ব জুড়ে আবারও করোনা দাপট, চিনে আক্রান্তের সংখ্যা দুই বছরের সর্বোচ্চ, ইউকে-তে হতে চলেছে ৫০ লক্ষ
আরও পড়ুন- দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে ওমিক্রনের নতুন রূপ BA.2- ৫টি পয়েন্টে জেনে নিন এর সম্পর্কে
"