সংক্ষিপ্ত
ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি দেশ ও বাঙালি জাতির মাথা উন্নত করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের আধিপত্যের মধ্যেই এমন এক স্বদেশিয়ানার কীর্তি তিনি স্থাপন করেছিলেন যাকে আজও গর্বভরে স্মরণ করে তামাম ভারতবাসী।
অঞ্চিত গুপ্তা, প্রতিবেদক--- বাঙালির জাতির এক গর্ব তিনি। কারণ ব্রিটিশদের আধিপত্যের মাঝেই যেভাবে তিনি একজন নেটিভ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন তা সকলের কাছে ঈর্ষা করার মতোই ছিল। এক সংস্কৃতবান এবং শাস্ত্র বিধি মানা এক বাঙালি পরিবারের সন্তান ছিলেন হরিশচন্দ্র সরকার। আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। আর তাঁর সেই স্বপ্নের হাত ধরেই একদিন চেপে বসেছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার বিমানের ককপিটে। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসাবে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের পাইলট হন। প্রবল বুদ্ধিমত্তার অধিকারী, সঙ্গে এক স্পোর্টসম্যান স্পিরিট এবং অবশ্যই এক দক্ষ ক্রীড়াবিদের মতো চেহারা- হরিশচন্দ্র সরকারের প্রাণপ্রাচুর্য-সাহসীকতা এবং শারীরিক স্ফূর্তির যা ছিল গোপন রহস্য। আর তাঁর এই শারীরিক ও মানসিক শক্তি অন্য যে কোনও কারও থেকে তাঁকে যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারে এগিয়ে রাখত।
সালটা ১৯৩০-এর সেপ্টেম্বর। হরিশচন্দ্র সরকারকে পাইলটের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করল ব্রিটিশ সরকার। তাঁর সঙ্গে আরও ৫জন ছিলেন। ব্রিটেনের লিঙ্কোশায়ারের ব়্যাফ কলেজ কর্নওয়েলে পাইলটের ট্রেনিং-এ যোগ দিলেন হরিশচন্দ্র। বিমান ওড়ানোর খুটিনাটি বিষয় শেখানো থেকে শুরু করে, অ্যাভ্রো লিঙ্কস, আমস্ট্রং হুইটওরথ অ্যাটলাস এবং এডবলু সিসকিন-এর মতো বিমান হাতে ধরে ওড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় হরিশচন্দ্র সরকার এবং তাঁর সঙ্গীদের। পাইলটের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরিশচন্দ্র সরকার ক্রীড়া ময়দানে দক্ষতা দেখাতে থাকেন। তিনি কলেজের হকি টিমের অধিনায়কও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৩২ সালের মধ্যেই ১৩০ ঘণ্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা ঝুলিতে পুরে নিয়েছিলেন হরিশচন্দ্র। ওই বছরই কর্নওয়েল থেকে আরও ৪ ভারতীয়-র সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। প্রশিক্ষণে হরিশচন্দ্র সকলকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন। হয়েছিলেন ১ নম্বর পাইলট। রাতারাতি সকলের কাছে ভরসার জায়গা হয়ে ওঠেন। তখনও ভারতীয় বায়ু সেনার জন্ম হয়নি। হরিশচন্দ্র ছুটলেন কয়েক মসের জন্য আর্মি কো-অপারেশন কোর্স করতে।
কোর্স শেষে দেখা গেল মেধাতালিকায় ৫ নম্বর স্থান দখল করেছেন হরিশচন্দ্র। আর তার আগে ১ থেকে ৪-এর মধ্যে যারা ছিল তারা সকলেই ব্রিটিশ অফিসার। হরিশচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন বৈষম্যের শিকার তিনি। কিন্তু, সেই অবস্থায় সরাসরি প্রতিবাদ করে উঠতে পারেননি। কিছু ভারতীয়র সঙ্গে হরিশচন্দ্রের পোস্টিং-ও ব়য়্যাল এয়ারফোর্সের ১৬ নম্বর স্কোয়াড্রনে করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ এই স্কোয়াড্রন-ই ভারতে এসে বায়ুসেনার ইউনিট খোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ১৯৩৩ সালের মার্চে ১৬ নম্বর স্কোয়াড্রনকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতে আসার পর কর্মস্থলে হরিশচন্দ্র সরকারের পথের অগ্রগতিতে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের দমন-পীড়ন। কারণস খোদ এক ব্রিটিশ হরিশচন্দ্র সরকারকে পিছনে সর্বোতভাবে সাহায্য করছিলেন। আর সেই ব্রিটিশ ভদ্রলোকের নাম ছিল বয় বোউচিয়ার। যিনি হরিশচন্দ্রের স্কোয়াড্রনের কমান্ডিং অফিসারের পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৩৩ সালে হরিশচন্দ্র আরও ২টি নতুন নজির স্থাপন করেন। প্রথম ভারতীয় হিসাবে ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান ওড়ানোর ইতিহাস যেমন রচনা করেছিলেন হরিশচন্দ্র, তেমনি প্রথম ভারতীয় পাইলট হিসাবে বিমানে একক অভিযান করে আরও এক ইতিহাস তৈরি করেন।
বিমান চালানোয় হরিশচন্দ্রের দক্ষতা দেখে তাঁকে দ্রুত ভারতীয় বায়ুসেনার সদস্য করে নেওয়া হয়। আর সেই সঙ্গে তিনি বোউচিয়ার ও ফ্লাইট কমান্ডর পিটার ব্রডের অন্যতম সঙ্গী হয়ে ওঠেন। এমনকী, রাজার জন্মদিন পালনে তিনি প্রথম ভারতীয় পাইলট যিনি ফ্লাইপাস্টে অংশ নিয়েছিলেন।
১ বছরের মধ্যেই বায়ুসেনার তারকা পাইলট হয়ে উঠেছিলেন হরিশচন্দ্র। তারমধ্যে তিনি ফ্লাইট কমান্ডার বোউচিয়ার-এর প্রিয়পাত্র হওয়ায় হরিশচন্দ্রের পক্ষে কাজ করাটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যে হরিশচন্দ্র একাই বিমান নিয়ে ফোটোগ্রাফি থেকে শুরু করে ফ্রন্ট অ্যাটাক, বম্বিং, ক্লোজ রেসে এবং কোঅপারেশন এক্সাসাইজ-এও দক্ষ হয়ে ওঠেন।
বোউচিয়ার একমাত্র একজন ছিলেন যিনি একার ক্ষমতায় ভারতীয় বায়ুসেনার বহরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তারমধ্যে ব্রিটিশ শাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা ভারতীয় বায়ু সেনার অস্তিত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এদিকে বোউচিয়ারের মাথায় তখন ছাদ ভেঙে পড়ার জোগার। কারণ, তাঁর ৫ পাইলটের মধ্যে ২ পাইলট বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তারমধ্যে আবার কম মাইনের জন্য বিমানবন্দরের কর্মীরা কর্মবিরতিতে চলে যায়।
১৯৩৫ সালের ৮ জানুয়ারি। একটি ওয়াপ্তি বিমান নিয়ে যাচ্ছিলেন হরিশচন্দ্র। যাতে বালুচের ৪ বাই ১০ নম্বর ট্রুপের জওয়ানরা ছিল। কিন্তু, বিমান নিয়ে দূর্ঘটনায় পড়েন হরিশচন্দ্র। এতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। কোনওভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন হরিশচন্দ্র এবং আব্দুল সালাম নামে এক গার্নার। এই ঘটনার পর ভারতীয় বায়ুসেনার অস্তিত্ব আরও সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিল।
এরপর একদিন বোউচিয়া এবং ফিলিপের সঙ্গে বিমানের মহড়া দিচ্ছিলেন হরিশচন্দ্র। এই সময় হরিশচন্দ্র গভীরভাবে ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে প্রবল ঝড় ও বৃষ্টির খপ্পরে পড়েন। ঝোড়ো বাতাসকে খপ্পর থেকে বের করার বৃথা চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত হরিশচন্দ্রের বিমান ভেঙে পড়ে এবং বিমানে আগুন ধরে যায়। এরপর হরিশচন্দ্র-কে বায়ুসেনা কোর্ট মার্শাল করে বহিষ্কার করে। তাঁর বিরুদ্ধে সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ হয়েছিল। কিন্তু, পরে তা প্রত্যাহার করা হয়।
তৎকালীন সময়ে ভারতীয় বায়ুসেনার সঙ্গে যুক্ত বহু ব্রিটিশ হরিশচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকী স্কোয়াড্রন লিডার নর্টন আদালতে সওয়াল করেছিলেন যে বিমানের ভেঙে পড়া এবং আগুন ধরে যাওয়ার সঙ্গে হরিশচন্দ্রের কোনও যোগ নেই। কারণ হাওয়ার গতিবেগ এতটাই ছিল যে তাতে মেকানিক্যাল ফল্ট তৈরি হয়েছিল নিজে থেকেই। নর্টন আদালতকে জানান প্রবল হাওয়ায় এরোফিলস কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। যার ফলে বিমান যখন গোত্তা খেয়ে নিচে নামছিল তখন এরোফিলস ঠিক করে কাজ করেনি।
মানসিক হতাশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন স্কোয়াড্রন কমান্ড্যান্ট বোউচিয়ার। হরিশচন্দ্রের সঙ্গে কয়েক মাস তিনি কথা বলতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল হরিশচন্দ্রকে নিশ্চিতভাবে তাঁরা বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু বাস্তবে তা করে উঠতে পারেননি। চোখের জল ফেলতে ফেলতে প্রিয় বন্ধু হরিশচন্দ্রকে বিদায় জানিয়েছিলেন অবন এবং মুখার্জি। ভারতীয় বায়ু সেনার জন্মলগ্নে যে ৫ জন ভারতীয়কে পাইলট হিসাবে নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে তখন হরিশের বিদায়ের পর অবন ও মুখার্জি থেকে গিয়েছিলেন বাহিনীতে।
হরিশচন্দ্র পরে অসামরিক বিমান পরিবহণে পাইলট হিসাবে কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে মারা যান হরিশ। ২০১৯ সালে হরিশচন্দ্রের ছেলের এই প্রতিবেদনের লেখকের সাক্ষাৎ হয়েছিল। হরিশচন্দ্রের লগ বুক লেখকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছেলে যাতে তা বায়ুসেনার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। হরিশচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার জন্মলগ্নের এক সম্ভাবনা। যাকে ঘিরে আরও হয়তো দ্রুত উন্নতির সোপান পেতে পারত বাহিনী। কিন্তু, এক মর্মান্তিক ঘটনা হরিশচন্দ্রের কেরিয়াকে শেষ করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন----
ভারতীয় নৌ-সেনা, বায়ুসেনা ও সেনা বাহিনী এখন আরও শক্তিশালী, যা সতর্কবার্তা দিচ্ছে চিনকে
আকর্ষণের কেন্দ্র সেই রাফাল যুদ্ধ বিমান, দেখে নিন বায়ু সেনা দিবসের কিছু ছবি
ডোকলামের পর থেকেই ঘুঁটি সাজাচ্ছিল চিন, লাদাখ উত্তাপের পরই তৈরি হয়েছে একাধিক বায়ু সেনা ঘাঁটি