সংক্ষিপ্ত

জম্মু প্রবেশের সময়ই গ্রেফতার হয়েছিলেন ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্য়ায়। ৪০ দিন পর রহস্যজনক পরিস্থিতিতে জম্মুর এক সরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। আজ অবধি গ্রেফতার ও মৃত্যু সম্পর্কিত সমস্ত রহস্য অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। তাঁর ৬৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে লিখলেন ভারতীয় জনতা পার্টির রাষ্ট্রীয় সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা।

 

জগৎপ্রকাশ নাড্ডা, সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি--  স্বাধীনতার পর থেকে, যদি এমন একটি নাম করতে হয়, যিনি জাতীয়তাবাদের ধারণার প্রচার করেছিলেন, জাতীয় সংহতিকরণের যাঁর ছিল অধ্যবসায়, যিনি দেশে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বিকল্পের বীজ বপন করেছিলেন, তিনি ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ নন। স্বাধীনতার পর ডা. মুখোপাধ্যায় দীর্ঘকাল বেঁচে না থাকলেও, তাঁর আদর্শ ও তাঁর সংগ্রাম ভারতীয় রাজনৈতিক মহাকাশে এক অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গিয়েছে।

ডা. মুখোপাধ্যায়ই প্রথম জম্মু ও কাশ্মীরের সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন এবং এর সম্পূর্ণ সমাধানের দাবিতে জোর গলায় আওয়াজ তুলেছিলেন। বাংলা ভাগের সময়ে তিনিই ভারতের অধিকার ও স্বার্থের জন্য সফলভাবে লড়াই করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে কংগ্রেসের ভারতীয়দের উপর আমদানীকৃত মতাদর্শ ও মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন ডা. মুখোপাধ্যায়। প্রত্যেক ভারতীয়র জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এবং টেকসই জীবনযাত্রা হিসাবে 'ভারত, ভারতীয় ও ভারতীয়ত্ব'-র রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

ভারতের প্রথম শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

স্বাধীনতার পর নেহেরু সরকারে ডা. মুখোপাধ্যায় ভারতের প্রথম শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন। সরকারে যোগ দিলেও, নেহেরু-লিয়াকত চুক্তিতে কংগ্রেস হিন্দুদের স্বার্থ সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করার কারণে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। তাঁর পদত্যাগ তাঁর আদর্শগত চেতনার উজ্জ্বল উদাহরণ। ডা. মুখোপাধ্যায় তাঁর আদর্শের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে তাঁর পদত্যাগই ছিল দেশের রাজনৈতিক বিকল্পের উত্থানের পূর্বসূর।

সকলেই জানেন, রাজনৈতিক নেতারা এবং বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা ভারতের স্বাধীনতার লড়াই করার জন্য কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় এসেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের রাজনৈতিক শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে এমন একটি বিকল্পের সন্ধানে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ভারত অধীর আগ্রহে এমন একটি রাজনৈতিক আদর্শের সন্ধান করছিল যার মূলে রয়েছে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাতীয় সংহতকরণ এবং তুষ্টিকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই। ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই এই বিতর্কের পতাকাবাহী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত জনসঙ্ঘ গঠনের পথ তৈরি করেছিল।

তাঁর একার প্রচেষ্টাতেই ১৯৫১ সালের ২১ অক্টোবর জনসঙ্ঘ গঠিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয়ত্বের অন্তর্নিহিত গুণাবলীতে সম্বৃদ্ধ এক রাজনৈতিক দলের বীজ বপন করা হয়েছিল। আমরা আজ যেখানে আছি, সেখানে পৌঁছতে বিগত বহু দশক ধরে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অতিক্রম করেছি, অনেক যুদ্ধ করেছি এবং প্রচুর বিপর্যয় এড়িয়েছি।

জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

১৯৫১-৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনসঙ্ঘ তিনটি আসন জিততে পেরেছিল। ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা আসন থেকে জিতে সংসদে পৌঁছেছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা, আদর্শের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এবং তাঁর দূরদর্শিতার জন্য বিরোধী দলগুলি একত্রিতভাবে তাঁকে লোকসভার বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত করেছিল। বিরোধী দলনেতা হিসাবে ডা. মুখোপাধ্যায় জোর গলায় জনগণের সমস্যা উত্থাপন করেছিলেন, এবং বিরোধী দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ডা. মুখোপাধ্য়ায় সর্বদা জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা জারি এবং পার্মিট ব্যবস্থাকে ভারতের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের পথে বাধা হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। এর জন্য তিনি বেশ কয়েকবার সংসদে আওয়াজ তুলেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুন জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে একটি বিতর্কে অংশ নিয়ে ডা. মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতে কীভাবে একটি রাজ্যের নাগরিকদের অধিকার এবং সুযোগসুবিধা অন্য রাজ্যের থেকে আলাদা হতে পারে এবং এটি ভারতের অখণ্ডতা এবং ঐক্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রবেশের জন্য পার্মিট পদ্ধতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।

ডা. মুখোপাধ্য়ায় জম্মু প্রবেশের সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন, যার ফলে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও গ্রেফতারি হয়েছিল। গ্রেফতারের ৪০ দিন পর, ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন, ভারতমাতার মহান পুত্র ডা. মুখোপাধ্য়ায় রহস্যজনক পরিস্থিতিতে জম্মুর এক সরকারি হাসপাতালে মারা যান। তাঁর শহিদ হওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু তত্কালীন নেহেরু সরকার এই বিষয় থেকে পুরোপুরি চোখ সরিয়ে রেখেছিল। ডা. মুখোপাধ্যায়ের মা যোগমায়া দেবী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে তাঁর ছেলের রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত করার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। তবে সেই অনুরোধও প্রত্যাখ্যাতহয়েছিল। আজ অবধি ডা. মুখোপাধ্য়ায়ের গ্রেফতার ও মৃত্যু সম্পর্কিত সমস্ত রহস্য অমীমাংতই রয়ে গিয়েছে।

জম্মুতে বিজেপির কার্যালয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ

 ডা. মুখোপাধ্য়ায় বলতেন - 'এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান আউর দো নিশান নাহি চলেগি' (ভারতে দুটি সংবিধান, দু'জন প্রধানমন্ত্রী ও দুটি জাতীয় প্রতাকা থাকতে পারে না)। এই স্লোগান প্রথমে জন সংঘ এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টির সংকল্প ও দিকনির্দেশক নীতিতে পরিণত হয়েছিল। ডা. মুখোপাধ্য়ায়ের এই স্বপ্ন- 'এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান অর দো নিশান নাহি চলেগি' - কি কখনও পূর্ণ হবে, কয়েক দশক ধরেই এই প্রশ্নটি ভারতের জনগণের মনে খোদিত ছিল।

এটা ছিল একটি আদর্শগত যুদ্ধ। একদিকে কংগ্রেস-সহ এমন দলগুলি ছিল, যারা সর্বদা তুষ্টিকরণের রাজনীতি করে, এবং অন্যদিকে ছিল বিজেপি, যে দল ৩৭০ ধারা বাতিল করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। জনসঙ্ঘের সময়ই হোক কিংবা বিজেপির সময়, আমাদের আদর্শে কোনও পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি অখণ্ড ও শক্তিশালী ভারত দেখার প্রতিশ্রুতির।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দৃঢ় ইচ্ছার ও একনিষ্ঠতা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দক্ষ কৌশল এবং পরিকল্পনার ফলেই ২০১৯ সালের অগাস্টে ভারত চিরতরে ৩৭০ ধারা অপসারণে সফল হয়েছিল। ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের 'এক বিধান, এক প্রধান এবং এক নিশান'-এর নিচে ভারতকে দেখার স্বপ্নপূরণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তির পাদদেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

ডা. মুখোপাধ্য়ায়ের সর্বোচ্চ ত্যাগ ব্যর্থ হয়নি, কারণ আমরা ৩৭০ ধারা অপসারিত করে এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে সত্যি অর্থে ভারতের সঙ্গে একীভূত করে, তাঁর ভারতকে একটি শক্তিশালী ও সংযুক্ত দেশ হিসাবে দেখার স্বপ্নকে সফলভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। ডা. মুখোপাধ্যায় সর্বদা 'ভারত মাতা'র একজন সত্যিকারের পুত্র হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন যিনি এমন একটি রাজনৈতিক সত্তা গঠন করেছিলেন, যা তার আদর্শের প্রতি সত্যিই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থেকে, একটি সংহত ও শক্তিশালী ভারত দেখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল এবং তার এই মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য তিনি শহিদ হয়েছিলেন। আমি এই মাটির মহান পুত্রের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।