সংক্ষিপ্ত

'বাবা বিশ্বনাথের পাগড়িটি আমি বিশেষভাবে তৈরি করি। এটা দুর্মূল্য। কেউ আমাকে লাখ টাকা দিয়ে দিলেও আমি এটা বিক্রি করব না’, জানালেন মুসলমান শিল্পী। তাঁর বিশেষ ইচ্ছা, একদিন তাঁর হাতের পাগড়ি উঠবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মাথায়। 

 

 

‘দেখেছি হিন্দু ললনাদের/ প্রতিরাত্রে বিয়ে দিচ্ছেন বিসমিল্লা খান’, কবি কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের সেই ‘নহবত’-উক্তি যে খুব-বেশি কাল্পনিক নয়, তা শিল্পী বিসমিল্লা খান ছাড়াও প্রমাণ করেছেন তাঁরই এলাকার আরও এক মহান কারিগর। তাঁর নাম হাজী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। মহান মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরকে প্রত্যেকটি ছবিতে যে পাগড়ি পরে থাকতে দেখা যায়, ভারতে সেই পাগড়ি তৈরি করতে পারেন একমাত্র শিল্পী মহম্মদ গিয়াসউদ্দিন। হিন্দুদের পবিত্র ভূমি বারাণসী, সেখানকারই লালাপুরায় দীর্ঘ প্রায় আড়াইশো বছর ধরে তাঁর পরিবারের পাগড়ি শিল্পের রমরমা। বর্তমানে, গিয়াসুদ্দিনই ভারতের একমাত্র পাগড়ি শিল্পী যিনি সেই ঐতিহাসিক পাগড়ি তৈরি করতে পারেন।

তবে, শুধুমাত্র মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর নন, তাঁর শিল্পের আরেকটি বিখ্যাত বিশেষত্ব আছে। পাঁচ গজ কাপড়ের তৈরি প্রথম পাগড়িটি তিনি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। গঙ্গার তীরে বিশ্বনাথ মন্দিরে ভগবান শিবকে তাঁর পাগড়ী অর্পণের অনুষ্ঠানটি ফাল্গুন মাসের পাক্ষিক একাদশীতে সম্পন্ন হয়। বাবা বিশ্বনাথের মূর্তিটি সবসময় বিশেষ ভূমির ওপর তৈরি হয়, বধূ পার্বতীকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। যেমন, চলতি বছরে এটি তৈরি হয়েছে বিশেষভাবে কারুকাজ করা কাশ্মীরের আখরোট কাঠের ওপরে। বারাণসীতে, স্থানীয় মানুষরা প্রত্যেক বছর হোলি উৎসব পালন করেন শিব এবং শক্তির বিবাহের উদযাপন হিসাবে। এই রীতিটি এই শহরে বেশ কয়েকদিন ধরে মুখর হয়ে থাকে। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ভগবান শিব যে বিশেষ পাগড়ি পরে আসছেন, তা মহম্মদ গিয়াসুদ্দিনের পরিবারের বিশেষত্ব। তাঁর পূর্বপুরুষরা কয়েক প্রজন্ম ধরে এটি তৈরি করে আসছেন এবং তিনি নিজেও আকবরী পাগড়ি তৈরির শিল্প আয়ত্ত করেছেন।

হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের জন্য বারাণসী শহরটি খুব বিখ্যাত হলেও হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মেলবন্ধনও এখানকার একটি গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের মতো বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলমান ব্যক্তিত্ব এখানকার মন্দিরে বা তার আশেপাশে বসে শিল্পের অনুশীলন করে গেছেন। বারাণসীতে একাদশী অনুষ্ঠানে গিয়াসুদ্দিনের পরিবার এখন উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। মহাম্মদ গিয়াসুদ্দিন শহরের লালাপুরা এলাকায় থাকেন। ভগবান শিবের জন্য সুন্দর পাগড়ি তৈরির পাশাপাশি, তিনি জন্মাষ্টমী তিথিতে ভগবান কৃষ্ণের জন্যও পাগড়ি তৈরি করেন। এছাড়াও, বিভিন্ন বিয়ে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে তৈরি পাগড়ি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

গিয়াসুদ্দিনের বক্তব্য, বাবা বিশ্বনাথের জন্য পাগড়ি বানানোটা একটা গুরুদায়িত্ব এবং সম্মানের বিষয়ও বটে। নিজের পূর্বপুরুষদের দ্বারা শুরু করা শিল্পের উত্তরাধিকারী হয়ে শিল্পটি বয়ে নিয়ে চলা তাঁর বিশেষাধিকার। তিনি বলেন, ‘আমার প্রপিতামহ হাজি চেদ্দি লখনউ থেকে এই শিল্প নিয়ে এসেছিলেন। তিনি শহরটি পছন্দ করেন এবং এখানে বসতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। সম্প্রীতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বাবা বিশ্বনাথকে পাগড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পুরোহিতরা তা গ্রহণ করেছিলেন।’ হাজী চেদ্দির ছেলে হাজী আব্দুল গফুর এই ঐতিহ্যকে অব্যাহত রেখেছেন এবং বংশ পরম্পরায় এটি এখন হাজী গিয়াসুদ্দিন আহমদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তার চার ছেলে। মানোয়ার আলী, আব্দুল সালাম, মহম্মদ কলিম, মহম্মদ সা. শাহিদ ও তার নাতি মহম্মদ। এঁরাও পাগড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। মাঝে মাঝে গিয়াসুদ্দিনের স্ত্রী আমিনা বানোও শিল্পের কাজে সহযোগিতা করেন। গিয়াসুদ্দিন বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে পাগড়ি বানাই, কেউ কাপড় কাটে, কেউ সেলাই করে, কেউ টুকরো সাজানোর কাজ করে।’

তাঁর রাজকীয় পাগড়ি সিল্কের কাপড়, জরি (সোনা বা রূপার সুতো), গোটা এবং কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি। একটি পাগড়ি তৈরি করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে। তিনি বলেন, ‘বাবা বিশ্বনাথের পাগড়িটি আমি বিশেষভাবে তৈরি করি। এটা দুর্মূল্য। কেউ আমাকে লাখ টাকা দিয়ে দিলেও আমি এটা বিক্রি করব না।’ তবে, এখনও একটি ইচ্ছে পূরণ হওয়া বাকি রয়েছে কারূশিল্পী মহম্মদ গিয়াসুদ্দিনের। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তাঁর হাতের তৈরি পাগড়ি পরলেই সমগ্র শিল্প স্বার্থক হবে বলে আশা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন পাগড়ির কারিগর।

আরও পড়ুন-

৪৭ বছর বয়সে গর্ভবতী ‘মা’! আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন ২৩ বছরের আর্যা, এক অপার আবেগে ভাসলেন মা ও মেয়ে
'আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ', টানা ৬ দিন ইডি হেফাজতের রায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়লেন অনুব্রত মণ্ডলের হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারি
মায়ের দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে ঢুকিয়ে আলমারিতে রেখে দিয়েছেন মেয়ে, মুম্বইয়ে হাড় হিম করা ঘটনা